রুপসীবাংলা৭১ তথ্যপ্রযুক্তি ডেস্ক : ছোট ছোট প্লাস্টিক কণা—চোখে দেখা যায় না, ছুঁয়েও বোঝা যায় না। অথচ এগুলো নীরবে শরীরের ভেতরে প্রবেশ করে ছড়িয়ে পড়ছে রক্ত, ফুসফুস, হৃৎপিণ্ড, এমনকি হাড়ের গভীরেও। গবেষকরা এগুলোর নাম দিয়েছেন—মাইক্রোপ্লাস্টিক। এসব কণা খাবার, পানীয় কিংবা শ্বাসের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত আমাদের শরীরে প্রবেশ করছে। সম্প্রতি প্রকাশিত একাধিক গবেষণা বলছে, এই মাইক্রোপ্লাস্টিকই হতে পারে আগামী দিনের স্বাস্থ্যঝুঁকির নীরব ঘাতক।
মাইক্রোপ্লাস্টিকের আকার ৫ মিলিমিটারের কম। অর্থাৎ, এগুলো এতটাই ছোট যে চোখে সহজে দেখা যায় না বা অনেক সময় মাটি, পানি কিংবা খাবারের মধ্যে মিশে থাকলেও বোঝা যায় না।
লন্ডনের উত্তরের নিস্তরঙ্গ হার্টফোর্ডশায়ারের এক মাঠে বিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো কৃষি-গবেষণা চলছে। ১৮৪৩ সালে ভিক্টোরীয় জমিদার জন বেনেট লজেস এটি শুরু করেন। মূলত গম উৎপাদন বাড়ানোর নানা উপায় পরীক্ষার জন্য এই গবেষণা শুরু হয়েছিল। আধুনিক প্রযুক্তির অনুপস্থিতিতে, তখন কেবল শুকনো গমের দানা, খড় এবং মাটি সংগ্রহ করে বোতলে ভরে রাখা হতো।
এই সংগ্রহ বর্তমানে হারপেনডেনের রথমস্টেড রিসার্চ কেন্দ্রে সংরক্ষিত। ১৮০ বছরেরও বেশি সময়ের এই সংগ্রহ মানব কর্মকাণ্ডের প্রভাবে পৃথিবীর পরিবেশে কী কী পরিবর্তন এসেছে, তার স্পষ্ট প্রতিফলন বহন করে।
সেই গবেষণাগারের বর্তমান দায়িত্বে রয়েছেন অ্যান্ডি ম্যাকডোনাল্ড, যিনি ‘কিপার অব দ্য বটলস’ নামে পরিচিত। ম্যাকডোনাল্ড জানান, ১৯৪০ ও ৫০-এর দশকের নমুনাগুলোতে পারমাণবিক বোমা পরীক্ষার কারণে তেজস্ক্রিয় উপাদান পাওয়া গেছে। তবে এখানেই শেষ নয়। ওই বোতলগুলোর অনেকগুলোতেই প্রথম মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি ধরা পড়ে।
একটি আলোচিত গবেষণায় বলা হয়েছে, একজন মানুষ বছরে গড়ে প্রায় ৫২,০০০টি মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা খাচ্ছে। যদিও এ সংখ্যাটি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, তবুও এটা পরিষ্কার—মাইক্রোপ্লাস্টিক এখন মানুষের শরীরে উল্লেখযোগ্য হারে প্রবেশ করছে। খাবার, পানি এমনকি বাতাসের মাধ্যমেও তা আমাদের শরীরে ঢুকছে। এগুলো মানুষের লালা, রক্ত, কফ, বুকের দুধ, যকৃত, কিডনি, প্লীহা, মস্তিষ্ক এবং এমনকি হাড়েও পাওয়া গেছে।
তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে—এসব প্লাস্টিক আমাদের শরীরে কী প্রভাব ফেলছে?
গবেষণার নতুন ধারা: প্লাস্টিক চ্যালেঞ্জ ট্রায়াল
২০২৫ সালের শুরুতে, লন্ডনে আটজন স্বেচ্ছাসেবককে নিয়েই ইতিহাসে প্রথমবারের মতো প্লাস্টিক চ্যালেঞ্জ ট্রায়াল চালানো হয়। তারা পরীক্ষামূলকভাবে মাইক্রোপ্লাস্টিক মিশ্রিত দ্রবণ পান করেন। এই গবেষণাটি পরিচালনা করেন ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের স্টেফানি রাইট। গবেষণাটির লক্ষ্য ছিল গরম পানি দিয়ে প্লাস্টিকের প্যাকেট বা বোতল ব্যবহারের ফলে আমাদের দেহে কী পরিমাণ মাইক্রোপ্লাস্টিক প্রবেশ করে তা বোঝা।
এই পরীক্ষায় স্বেচ্ছাসেবকদের রক্ত থেকে প্রতি ঘণ্টায় নমুনা নেওয়া হয় এবং তা বিশ্লেষণ করে দেখা হয় কতগুলো মাইক্রোপ্লাস্টিক রক্তপ্রবাহে প্রবেশ করছে। এর ফলাফল প্রকাশিত হবে ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ।
গবেষক রাইট বলেন, আমাদের দৈনন্দিন কাজ—যেমন প্লাস্টিকে মোড়া টি- ব্যাগ দিয়ে চা বানানো বা প্লাস্টিকের পাত্রে খাবার গরম করা—এসবই শরীরে মাইক্রোপ্লাস্টিক ঢোকার পথ। তিনি আরও জানান, আমাদের দেহ এগুলো ভাঙতে অক্ষম, ফলে এগুলো শরীরে জমে গিয়ে দীর্ঘমেয়াদি প্রদাহ বা অঙ্গ-প্রতঙ্গের ক্ষতি করতে পারে।
মানবদেহে মাইক্রোপ্লাস্টিক: গবেষণায় উদ্বেগজনক ইঙ্গিত
- ২০২৪ সালে চীনের এক গবেষণায় হাড় ও পেশিতে মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে। গবেষকদের ধারণা, এতে শারীরিক সক্ষমতা কমতে পারে এবং হাড় ও পেশির কোষের বৃদ্ধি ব্যাহত হতে পারে।
- ইতালির এক গবেষণায় হৃদযন্ত্রে রক্ত সরবরাহকারী ধমনীতে মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা ধমনীতে মাইক্রোপ্লাস্টিক বহন করছিলেন, তাদের হৃদরোগ, স্ট্রোক বা আকস্মিক মৃত্যুর ঝুঁকি ৪.৫ গুণ বেশি।
- ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত এক গবেষণায় মৃতদেহের মস্তিষ্কে মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে। যাদের ডিমেনশিয়া ছিল, তাদের মস্তিষ্কে অন্যদের তুলনায় ১০ গুণ বেশি মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে।
যুক্তরাজ্যের গবেষক ম্যাথিউ ক্যাম্পেন মনে করেন, মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা চর্বির সাথে মিশে মস্তিষ্কে প্রবেশ করে, বিশেষ করে ডিমেনশিয়ায় আক্রান্তদের ক্ষেত্রে।
তবে গবেষকেরা এখনো সরাসরি বলছেন না যে মাইক্রোপ্লাস্টিক ডিমেনশিয়া বা হৃদরোগের সরাসরি কারণ। বরং তারা মনে করেন, এগুলো দীর্ঘদিন ধরে শরীরের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে, যা অন্যান্য রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
মাইক্রোপ্লাস্টিকের নানা প্রভাব
এক লিটার বোতলজাত পানিতে প্রায় ২,৪০০০০টি পর্যন্ত মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা থাকতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে নানা ধরনের প্লাস্টিক যেমন নাইলন, পলিস্টাইরিন ইত্যাদি।
অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারেনা পিচলার বলেন, ‘মাইক্রোপ্লাস্টিক’ শব্দটি এই কণাগুলোর জটিলতা বোঝাতে যথেষ্ট নয়। প্রতিটি প্লাস্টিক কণা ভিন্ন রাসায়নিক গঠনের এবং ভিন্নভাবে শরীরের সাথে প্রতিক্রিয়া করতে পারে।
ন্যানোপ্লাস্টিক (যা মাইক্রোপ্লাস্টিকের চেয়েও ক্ষুদ্র) দেহের কোষের ভেতরে প্রবেশ করতে পারে এবং ডিএনএ ক্ষতিগ্রস্তকারী রিঅ্যাক্টিভ অক্সিজেন স্পেসিস উৎপন্ন করে কোষীয় আচরণ পরিবর্তন করতে পারে।
প্লাস্টিক ও রোগের যোগসূত্র
পিচলার বলেন, প্রদাহ সৃষ্টির মাধ্যমে মাইক্রোপ্লাস্টিক ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ টিউমার গঠনের ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে, যদিও সরাসরি সম্পর্ক এখনো গবেষণাধীন।
ইতালির গবেষক রাফায়েল মারফেলা মনে করেন, মাইক্রো ও ন্যানোপ্লাস্টিক দেহে দ্রুত বার্ধক্য ও অঙ্গপ্রতঙ্গের কার্যকারিতা হ্রাসে ভূমিকা রাখতে পারে। তিনি তার ল্যাবে মানব কোষ থেকে তৈরি কৃত্রিম রক্তনালী ব্যবহার করে পরীক্ষা চালাচ্ছেন এবং দেখার চেষ্টা করছেন, কতটুকু প্লাস্টিক গ্রহণ শরীরের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে।
কারা বেশি ঝুঁকিতে?
বয়স্ক বা অসুস্থ ব্যক্তিরা মাইক্রোপ্লাস্টিকের প্রভাবের প্রতি বেশি সংবেদনশীল। গবেষণায় দেখা গেছে, ক্যানসার রোগীদের শরীরে এসব কণা ওষুধের কার্যকারিতা হ্রাস করতে পারে।
অ্যাজমা বা দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসযন্ত্রের রোগ রয়েছে এমন রোগীদের নিয়েও গবেষণা করছেন যুক্তরাজ্যের গবেষক ফে কুসেইরো। তিনি রোগীদের কফ ও ঘরের বাতাসের নমুনা সংগ্রহ করছেন, যাতে বোঝা যায় মাইক্রোপ্লাস্টিক কীভাবে শ্বাসতন্ত্রে জমে এবং আক্রমণ বাড়ায়।
মাইক্রোপ্লাস্টিক এখন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। বাতাসে, পানিতে, খাবারে, এমনকি ঘুমের মধ্যেও আমরা তা গ্রহণ করছি। গবেষকরা এখন প্লাস্টিক উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর সঙ্গে কথা বলে নিরাপদ বিকল্প উদ্ভাবনের চেষ্টা করছেন; বিশেষ করে চিকিৎসা খাতের প্লাস্টিক সামগ্রী যেমন অক্সিজেন মাস্ক বা টিউব।
ফে কুসেইরোর ভাষায়, ‘যতদিন না আমরা নিরাপদ মাত্রা নির্ধারণ করতে পারছি, ততদিন এটি আমাদের স্বাস্থ্যঝুঁকির অংশ হয়ে থাকবে।’
এখন সময় এসেছে ভাববার—আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা প্লাস্টিক আমাদের শরীরের ভেতরে কী করছে এবং আমরা কীভাবে নিজেদের রক্ষা করতে পারি।
তথ্যসূত্র: বিবিসি, ন্যাচার জার্নাল
রুপসীবাংলা৭১/এআর