নিজস্ব প্রতিনিধিঃ আজ সকাল ৯ ঘটিকায় রাজধানী ঢাকার শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে ধরা ও ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ এবং বিডি ট্যুরিস্ট সাইক্লিস্ট যৌথভাবে এক সমাবেশ এবং সাইকেল র্যালির আয়োজন করে, প্রাচ্যের জন্য প্রতি বছর ৫ ট্রিলিয়ন ডলার (প্রায় ৫ কোটি ৯৭ লক্ষ ৭০ হাজার কোটি টাকা) জলবায়ু তহবিল প্রদানের দাবিতে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াজুড়ে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর অংশ হিসেবে ঢাকাসহ দেশের ছয়টি জেলার ১০টি স্থানে জলবায়ু অর্থায়নের দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ ও সাইকেল র্যালি আয়োজন করা হয়।
এ সময় ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশের যোগাযোগ ও অ্যাডভোকেসি বিভাগের ব্যবস্থাপক মামুন কবীরের সঞ্চালনায় এবং ধরা’র অন্যতম নেতা এবং ব্রহ্মপুত্র এফিলিয়েট রিভারকিপার ইবনুল সাঈদ রানার সভাপতিত্বের অনুষ্ঠিত সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন ধরা’র সহ-আহ্বায়ক এবং বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের বেসরকারি উপদেষ্টা এমএস সিদ্দিকী। সমাবেশে অতিথি হিসাবে আরো উপস্থিত ছিলেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকুয়াকালচার বিভাগের চেয়ারম্যান সহকারী অধ্যাপক মীর মোহাম্মদ আলী, বিডি ট্যুরিস্ট সাইক্লিস্টের প্রধান সমন্বয়কারী মোঃ আমিনুল ইসলাম টুব্বুস, রিভার এন্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট বাংলাদেশ’র সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল গাজী এবং ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ এর গবেষণা বিভাগের ব্যবস্থাপক মো. ইকবাল ফারুক প্রমূখ।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে এমএস সিদ্দিকী বলেন, আজকের এই সমাবেশ ও সাইকেল র্যালির মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশ এবং বিশ্ববাসীকে জানাতে চাই যে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ দায়ী নয়, বরং এর দায় পশ্চিমা বিশ্বের। অথচ আমাদের ক্ষতির জন্য আমরা তাদের কাছ থেকে অনুদানের বদলে ঋণ পাই, যা আমাদের উপর আরও বোঝা বাড়ায়। এর ঋণ খরচের পরিকল্পনা ও কনসাল্টেন্সি আবার তারাই করে, ফলে মূল অর্থ আবার তাদের কাছেই ফিরে যায়। এই চক্র ভাঙতে হবে এবং পশ্চিমা দেশগুলোকে ন্যায়সঙ্গতভাবে জলবায়ু তহবিলের মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
সভাপতির বক্তব্যে ইবনুল সাঈদ রানা বলেন, পশ্চিমা দেশগুলো তাদের বিলাসী জীবনযাত্রার জন্য পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়িয়েছে এবং বাংলাদেশসহ প্রাচ্যের দেশগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। আজকের কর্মসূচির মাধ্যমে আমরা জানাতে চাই, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষয়ক্ষতি পূরণের জন্য প্রাচ্যের দেশগুলোর জন্য প্রতি বছর পাঁচ কোটি সাতানব্বই লক্ষ সত্তর হাজার কোটি টাকা অনুদান হিসাবে প্রদান করতে হবে।
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকুয়াকালচার বিভাগের চেয়ারম্যান মীর মোহাম্মদ আলী বলেন, পশ্চিমা দেশগুলো শিল্পায়নের মাধ্যমে লাভবান হয়েছে, কিন্তু এর ফলে উপকূলীয় দেশগুলোকে বিপদের মুখে ফেলে দিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা বেড়ে গেছে, যার ফলে খাদ্য ও ব্যবহারের পানির সংকট দেখা দিয়েছে। আমাদের দেশের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য আমরা জলবায়ু তহবিল চাই, তবে সেটি অনুদান হতে হবে, ঋণ নয়।
বিডি ট্যুরিস্ট সাইক্লিস্টের প্রধান সমন্বয়কারী মোঃ আমিনুল ইসলাম টুব্বুস বলেন, “আমরা সাইক্লিস্ট হিসেবে সাইকেল চালিয়ে বিশ্বকে জানাতে চাই যে, পৃথিবীর উষ্ণতা কমানোর জন্য সাইকেলের ব্যবহার বাড়াতে হবে এবং ফসিল গ্যাস চালিত গাড়ির ব্যবহার কমাতে হবে। সেইসঙ্গে, ইতোমধ্যে হওয়া ক্ষতির জন্য আমরা ন্যায্য ক্ষতিপূরণও চাই।
ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশের গবেষণা বিভাগের ব্যবস্থাপক ইকবাল ফারুক বলেন, আজকের এই সমাবেশ থেকে আমরা স্পষ্টভাবে জানাতে চাই যে, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য আমরা দায়ী নই, তাই এর দায়ও আমাদের নয়। পশ্চিমা দেশগুলো, যারা এর জন্য দায়ী, তাদের অবশ্যই এই ক্ষতিপূরণ দিতে হবে এবং সেটি হতে হবে অনুদান হিসেবে, ঋণ নয়।
যোগাযোগ ও অ্যাডভোকেসি বিভাগের ব্যবস্থাপক মামুন কবীর বলেন, পাশ্চাত্যের দেশগুলোর ঐতিহাসিক এবং চলমান ভূমিকার কারণে তাদের ওপর বিশাল জলবায়ু ঋণ বর্তায়, যা প্রাচ্যের মানুষের উপর চরম প্রভাব ফেলেছে। তাদের সরকারের দায়িত্ব হলো এই ঋণ পরিশোধ করা এবং জলবায়ু পরিবর্তন থেকে সৃষ্ট চরম আবহাওয়ার ক্ষতি পূরণ করা। জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনের অধীনে এই দায়বদ্ধতা স্বীকৃত হয়েছে, যা ধনী দেশগুলোকে প্রাচ্যের অভিযোজন ও ক্ষয়ক্ষতি পূরণে অনুদান ভিত্তিক জলবায়ু অর্থ প্রদানে বাধ্য করে।
সমাবেশ শেষে কয়েকশ’ সাইক্লিস্ট জলবায়ু তহবিলে অর্থায়নের দাবিতে আয়োজিত সাইকেল র্যালিতে অংশ নেয়। র্যালিতে অংশগ্রহণকারীরা “জলবায়ু তহবিলে অর্থায়ন কর”, “তোমার ঋণ তুমিই পরিশোধ কর”, “জলবায়ু অর্থ এখনই পরিশোধ কর”, “শতভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে অর্থায়ন কর”, এবং “জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ কর”—এ ধরনের স্লোগান লেখা ফেস্টুন ও প্ল্যাকার্ড বহন করেন।
সাইকেল র্যালি শেষে শাহবাগে ধরা এবং ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশের উদ্যোগে “ক্লাইমেট স্ট্রাইক ২০২৪” অনুষ্ঠিত হয়। এই ক্লাইমেট স্ট্রাইকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট ক্ষয়-ক্ষতি মোকাবেলায় অর্থায়নের দাবি এবং জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্তে শতভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগের আহ্বান জানানো হয়। ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা তরুণ ও যুবকেরা এই স্ট্রাইকে অংশগ্রহণ করেন। এতে উপস্থিত ছিলেন ধরা’র সহ-আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের বেসরকারি উপদেষ্টা এমএস সিদ্দিকী, ধরা’র নেতা ইবনুল সাঈদ রানা, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকুয়াকালচার বিভাগের চেয়ারম্যান মীর মোহাম্মদ আলী, বিডি ট্যুরিস্ট সাইক্লিস্টের প্রধান সমন্বয়কারী আমিনুল ইসলাম টুব্বুস, রিভার এন্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল গাজী এবং ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশের ইকবাল ফারুক, মামুন কবীর, সাঈদ হোসাইন, এবং মূকাভিনয় শিল্পী শাহরিয়ার শাওন।
একই সময়ে সিলেটের জৈন্তাপুর, বাগেরহাটের মোংলা, কক্সবাজারের পেকুয়া, কুতুবদিয়া, কক্সবাজার সদর, মহেশখালী, বরগুনার পাথরঘাটা, বরগুনা সদর, তালতলী এবং পটুয়াখালীর কুয়াটাকা উপজেলায়ও জলবায়ু তহবিলে অর্থায়নের দাবিতে সমাবেশ ও সাইকেল র্যালি অনুষ্ঠিত হয়।
এশিয়ান পিপলস মুভমেন্ট অন ডেট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এপিএমডিডি) এবং এশিয়া এনার্জি নেটওয়ার্ক (এইএন) যৌথভাবে এশিয়াজুড়ে এই কর্মসূচির আয়োজন করে। বাংলাদেশে ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) ও ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশসহ স্থানীয় সংগঠন এবং সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসী এই কর্মসূচিগুলো আয়োজনে সহায়তা করে। নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন ও ভবিষ্যতের শীর্ষ সম্মেলনের আগে এই বিক্ষোভগুলি আয়োজন করা হয়েছে। এটি ‘গ্লোবাল উইক অফ অ্যাকশন’ এর অংশ, যা ৫৮টি দেশে এক সপ্তাহব্যাপী চলবে, যেখানে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ এবং জলবায়ু তহবিল প্রদানের আহ্বান জানানো হয়েছে।
এপিএমডিডি সমন্বয়কারী লিডি ন্যাকপিল কর্মসূচি উপলক্ষে বলেছেন, ২০২৪ জলবায়ু সংকটে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য একটি বিধ্বংসী বছর ছিল। বছরের প্রথমার্ধে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চরম তাপপ্রবাহের কারণে স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে, খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে এবং পাওয়ার গ্রিড ভেঙে পড়েছে। দক্ষিণ পাকিস্তানে হিট স্ট্রোকে মাত্র ছয় দিনে ৫৬৮ জন প্রাণ হারিয়েছে। বছরের দ্বিতীয়ার্ধে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে মৌসুমী বৃষ্টি বেড়ে গিয়ে বাংলাদেশে শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা সৃষ্টি করেছে, যার ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষ আটকা পড়েছে এবং ২৮২ মিলিয়ন ডলার মূল্যের ফসলের ক্ষতি হয়েছে। ফিলিপাইনে এল নিনো এই বছর ৯.৫ বিলিয়ন পেসো লোকসান করেছে, যার ফলে ১,৭৫,০০০ এরও বেশি কৃষক ও মৎস্যজীবী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই বছরের চরম আবহাওয়ার ঘটনাগুলো আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে পূর্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ মানুষদের, যারা বৈশ্বিক নির্গমনে সামান্য অবদান রাখে, তাদেরই জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় মূল্য দিতে হয়।
ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) এর সদস্য সচিব এবং ওয়াটারকিপার্স বাংলদেশ এর সমন্বয়ক শরীফ জামিল কর্মসূচি উপলক্ষে বলেন, জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনের (ইউএনএফসিসিসি) অধীনে, উন্নত দেশগুলো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জলবায়ু কর্মসূচি ও প্রকল্পগুলোর জন্য অর্থ সহায়তা প্রদানে সম্মত হয়েছে। গ্লোবাল সাউথের জন্য জলবায়ু অর্থায়নের লক্ষ্য বাড়ানো নিয়ে আলোচনা হবে আসন্ন নভেম্বরে কপ-২৯ সম্মেলনে, যা একটি গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা হিসেবে সামনে থাকবে। আশা করা হচ্ছে, কপ-২৯-এ জলবায়ু অর্থায়নের জন্য একটি নতুন যৌথ পরিমাপকৃত লক্ষ্য (এনসিকিউজি) নির্ধারণ করা হবে, যা পূর্বের ১০০ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্যকে প্রতিস্থাপন করবে। এই আগের লক্ষ্যকে অপর্যাপ্ত বলে সমালোচনা করা হয়েছে। উপকূলীয় ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে, আমরা আমাদের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় এবং অভিযোজন কার্যক্রমে অবিলম্বে জলবায়ু তহবিলে অর্থায়নের দাবি জানাচ্ছি।