রুপসীবাংলা৭১ প্রতিবেদক : রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে প্রণীত ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’ বাস্তবায়নের সুপারিশের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে কোনো প্রস্তাব না আসায় সরকার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবে। এ ক্ষেত্রে পরস্পরবিরোধী অবস্থানে থাকা বিএনপি ও জামায়াতের দাবি সমন্বয়ের চেষ্টা চলছে। আজ বৃহস্পতিবার সকালে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এসংক্রান্ত প্রস্তাব ওঠানো হবে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠেয় উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের এক নম্বর আলোচ্য বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে ‘জুলাই সনদ’ ইস্যু।
বৈঠক শেষে দুপুরে প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। ভাষণে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে সরকারের সিদ্ধান্ত জানানো হতে পারে।
জুলাই সনদ বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে পরস্পরবিরোধী অবস্থানে অনড় রয়েছে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ তাদের সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো। জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আদেশ জারি, গণভোটের সময় নির্ধারণ, ভোটের সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বে (পিআর) সংসদের উচ্চকক্ষ গঠন এবং নোট অব ডিসেন্টের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে বিএনপি ও তার মিত্র দলগুলোর সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীসহ তাদের সমমনা দলগুলোর মতপার্থক্য অবসানে সরকারের বেঁধে দেওয়া সময়ে কোনো সমঝোতা হয়নি।
এ কারণে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকেই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি চূড়ান্ত করতে পদক্ষেপ গ্রহণের কথা জানিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং।
জান গেছে, আজ উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ‘জাতীয় জুলাই সনদ-২০২৫ বাস্তবায়ন’ পদ্ধতি চূড়ান্ত করা হবে। বৈঠকের ছয়টি এজেন্ডার মধ্যে এক নম্বরে রয়েছে ‘জুলাই সনদ ২০২৫ বাস্তবায়ন’। ওই বৈঠকে মোট পাঁচটি নির্দিষ্ট এজেন্ডা রয়েছে, আর ছয় নম্বরে ‘বিবিধ’ বিষয় রাখা হয়েছে।
বৈঠকে জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ-২০২৫ জারি এবং গণভোটের জন্য অধ্যাদেশ জারির বিষয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে। এর আগে গত ৩ নভেম্বরের উপদেষ্টা পরিষদের সভা শেষে চলমান সংকট নিরসনে রাজনৈতিক দলগুলোকে সাত দিনের মধ্যে সমঝোতায় পৌঁছানোর সময় দিয়েছিল সরকার। গত ১১ নভেম্বর আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, দুই-তিন দিনের মধ্যেই জুলাই সনদ নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানা যাবে। আজ প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে সেই সিদ্ধান্ত প্রকাশ হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানিয়েছে, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস আজ (১৩ নভেম্বর) দুপুরে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন।
বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি), বিটিভি নিউজ ও বিটিভি ওয়ার্ল্ড ভাষণটি সরাসরি সম্প্রচার করবে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, প্রধান উপদেষ্টা তাঁর ভাষণে জুলাই জাতীয় সনদ বা প্রস্তাবিত সংস্কার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনার পাশাপাশি সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অন্তর্বর্তী সরকারের চলমান কার্যক্রম নিয়ে কথা বলতে পারেন। এ ছাড়া দেশের অর্থনীতি, প্রশাসনিক সংস্কার ও আসন্ন নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়েও তিনি জাতিকে অবহিত করবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টার এই ভাষণকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকমহল মনে করছে।
সরকারের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, আগামী ১৫ নভেম্বরের মধ্যে সরকারের জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারি এবং এরপর গণভোটের জন্য অধ্যাদেশ জারি করার পরিকল্পনা রয়েছে। সেই লক্ষ্য সামনে রেখে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ইস্যুতে দলগুলোর অবস্থান বিবেচনায় নিয়ে সমন্বয় করে ভারসাম্যমূলক সমাধানের একটি উপায় নির্ধারণ করতে যাচ্ছে সরকার। এ ক্ষেত্রে আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনই গণভোট, নোট অব ডিসেন্টের বিষয়ে নতুন বিবেচনা এবং সংসদের উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতির সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হতে পারে।
অবশ্য এ নিয়ে গতকাল বুধবার সচিবালয়ে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, অর্থ উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বৈঠক করেছেন। ওই বৈঠকে সনদ বাস্তবায়নে কিছু প্রস্তবা উঠে এসেছে।
একাধিক সূত্র জানিয়েছে, বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির দাবি সমন্বয় করে ভারসাম্যমূলক সিদ্ধান্ত দেওয়ার পরিকল্পনা করছে সরকার। বিএনপির দাবি অনুযায়ী, নির্বাচন ও গণভোট এক দিনে হতে পারে এবং সংসদের ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদকে’ নোট অব ডিসেন্ট অনুযায়ী সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা দেওয়া হবে। জামায়াত, এনসিপিসহ অন্যান্য দলের দাবি পূরণে পিআর পদ্ধতিতে সংসদের উচ্চকক্ষ গঠনের বিধান থাকতে পারে।
সূত্র জানায়, জুলাই জাতীয় সনদের সংবিধানসংক্রান্ত প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নে গণভোটে চারটি প্রশ্ন রাখা হতে পারে। সংবিধানসংক্রান্ত ৪৮টি সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে যে ৩০টি প্রস্তাবে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) বেশির ভাগ দল একমত, সেগুলো নিয়ে গণভোটে একটি প্যাকেজ প্রশ্ন রাখা হতে পারে। সেখানে ভোটারদের কাছে জানতে চাওয়া হবে—এই ৩০টি সংস্কার প্রস্তাবের বাস্তবায়ন চান কি না। এর বাইরে ১৮টি সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে বড় ধরনের মতবিরোধ আছে। এর মধ্যে বেশির ভাগই মৌলিক সংস্কার প্রস্তাব। এগুলো নিয়ে গণভোটে আলাদা তিন-চারটি প্রশ্ন করার চিন্তা হচ্ছে। পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাসহ যেসব মৌলিক প্রস্তাবে বড় দল, বিশেষ করে বিএনপির ভিন্নমত আছে, সেগুলো নিয়ে আলাদা কয়েকটি প্রশ্ন থাকবে।
উল্লেখ্য, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ৩০টি দলের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ছয়টি সংস্কার কমিশনের ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’ প্রণয়ন করেছে। ৮৪টি প্রস্তাবের মধ্যে ৪৮টি সংবিধান সম্পর্কিত। এর মধ্যে অন্তত ৩০টি প্রস্তাবে কোনো না কোনো দলের ভিন্নমত আছে। সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশে ভিন্নমতের বিষয়টি রাখা হয়নি। সংবিধানসংক্রান্ত ৪৮টি প্রস্তাব খসড়া আদেশের তফসিলে রাখা হয়েছে। একটি আদেশ জারি করে গণভোট করার সুপারিশ ছিল ঐকমত্য কমিশনের। সেখানে একটিই প্রশ্ন রাখার সুপারিশ ছিল। সেটি হলো, জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ অনুমোদন করেন কি না এবং এর তফসিলে থাকা সংস্কার প্রস্তাবগুলো সমর্থন করেন কি না। গণভোটের সময় নিয়ে সিদ্ধান্তের ভার সরকারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
রুপসীবাংলা৭১/এআর

