রুপসীবাংলা৭১ প্রতিবেদক : দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে হলে জনগণের ভোটে নির্বাচিত একটি স্থিতিশীল সরকার প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি বলেছেন, ‘রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স—এই মুহূর্তে এ দুটি খাতই দেশের অর্থনীতির প্রধান ভরসার খাত। গত কয়েক মাসে রপ্তানি খাতেও নেতিবাচক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। দেশের ব্যবসায়ীসমাজ এবং বিদেশে বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগীরাও অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য নির্বাচিত একটি স্থিতিশীল সরকারের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছে।’
গতকাল বুধবার বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে ঐতিহাসিক জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে বিএনপি আয়োজিত আলোচনাসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তারেক রহমান এসব কথা বলেন।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে বলেন, ‘এখন সরকারকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তারা কি একটি রাজনৈতিক দলের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করবে? নাকি দেশের গণতন্ত্রকামী জনগণের কাছে জবাবদিহিমূলক একটি সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচনকেই অগ্রাধিকার দেবে।’
বিজিএমইএর তথ্যের উদ্ধৃতি দিয়ে দেশের জনগণের উদ্দেশে তারেক রহমান বলেন, “গত ১৪ মাসে সাভার, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদীতে কমপক্ষে ৩৫৩টি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে এক লাখ ২০ হাজারের মতো শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েছেন।
কর্মহীন এই মানুষগুলোর কাছে রাষ্ট্রের হাজার টাকা ব্যয় করে কথিত ‘গণভোট’-এর চেয়ে একটি চাকরি কি বেশি জরুরি নয়? আপনারা কী বলেন?”
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, “নারীর কর্মঘণ্টা কমানোর কথা বলে চাকরিদাতাদের কৌশলে নারীদের চাকরি না দেওয়ার জন্য উৎসাহিত করা হচ্ছে কি না—দেশের নারীসমাজের মধ্যে এমন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষ যখন কর্মহীন হয়ে পড়ছে, আমার মনে হয় এমন পরিস্থিতিতে কর্মজীবী নারীদের মনে ছড়িয়ে পড়া চাকরি সংকোচনের আতঙ্ক কাটানো এই মুহূর্তে কথিত ‘গণভোট’-এর চেয়ে বেশি দরকার।”
কোনো কোনো রাজনৈতিক দল জাতীয় নির্বাচনে বাধার সৃষ্টি করছে জানিয়ে তারেক রহমান বলেন, ‘আমরা দেখতে পাচ্ছি, কোনো কোনো রাজনৈতিক দল নানা শর্ত দিয়ে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাধা সৃষ্টি করতে চাইছে। জাতীয় নির্বাচন নিয়ে জটিলতা সৃষ্টির অর্থ একদিকে নির্বাচন না করেই রাষ্ট্রযন্ত্রে খবরদারির সুযোগ গ্রহণ করা, অন্যদিকে পতিত পরাজিত পলাতক স্বৈরাচারের পুনর্বাসনের পথ সুগম করা।
পলাতক স্বৈরাচারীর সহযোগীরা গত কয়েক দিনে খোদ রাজধানীতে যেভাবে আগুন সন্ত্রাস চালিয়েছে, ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তির করণীয় সম্পর্কে এটি একটি সতর্কবার্তা হতে পারে বলে আমি মনে করি।’
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, ‘দেশ ও জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং জনসমর্থিত দল হওয়া সত্ত্বেও ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্য অটুট রাখার ব্যাপারে বিএনপি সর্বোচ্চ ছাড় দিয়েছে। এটি কথার কথা নয়, এটি প্রমাণিত সত্য। রাজনৈতিক ঐকমত্য কমিশনের প্রতিটি দফা পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, বিএনপি বেশির ভাগ পয়েন্টেই ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছে।’
জুলাই সনদে বিএনপির অঙ্গীকারের বিষয়ে তারেক রহমান বলেন, ‘আমাদের বক্তব্য পরিষ্কার।
সনদে যা অঙ্গীকার করা হয়েছে বিএনপি এসব অঙ্গীকার রক্ষা করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তবে কোনো রাজনৈতিক দল যদি অন্তর্বর্তী সরকারকে দুর্বল পেয়ে যা ইচ্ছা তাই আদায় করে নিতে চায় কিংবা বিএনপির বিজয় ঠেকাতে অপকৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করে, সেটি শেষ পর্যন্ত তাদের নিজেদের জন্যই রাজনৈতিক বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায় কি না সে ব্যাপারে সতর্ক থাকা দরকার। ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের রাজপথের সঙ্গীদের প্রতি আহবান, অযথা পরিস্থিতি ঘোলাটে করবেন না।’
গণতন্ত্রকামী জনগণের প্রতি আহবান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘গণভোটের আড়ালে পতিত পরাজিত পলাতক অপশক্তিকে রাষ্ট্রীয় রাজনীতিতে পুনর্বাসনের সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে কি না আমি এ ব্যাপারেও সতর্ক দৃষ্টি রাখার জন্য দেশের গণতন্ত্রকামী জনগণের প্রতি আহবান জানাই। স্বল্প মেয়াদের অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জনগণ সব ক্ষেত্রে সার্বিক সফলতা আশা করে না। এটি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান দায়িত্বও নয়। অন্তর্বর্তী সরকার দেশে আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় নির্ধারণ করেছে।’
দেশে বেকারত্বের হার নিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, ‘দেশে বেকারত্বের হার বেড়েই চলেছে। সম্প্রতি একটি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের রিপোর্টে বলা হয়েছে, দেশে বর্তমানে দারিদ্র্যের হার ২৮ শতাংশ। আরো ১৮ শতাংশ মানুষ যেকোনো সময় গরিব হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। দেশে শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার বাড়ছে। দেশে উচ্চ মাধ্যমিক ও গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রিধারী প্রতি পাঁচজনের একজন বেকার।’
তারেক রহমান আরো বলেন, ‘আনফরচুনেটলি, আমরা মাসের পর মাস রাষ্ট্র মেরামতের নানা উপাদান নিয়ে আলোচনা করলেও এই রাষ্ট্রে লাখ লাখ বেকারের কর্মসংস্থান নিয়ে আলোচনার জন্য একটি দফাও উত্থাপন করিনি বলেই মনে হয়। দীর্ঘ দেড় দশকের ফ্যাসিবাদী শাসনামলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। এত সংস্কার কমিটি হলো, অথচ একটি শিক্ষা সংস্কার কমিটি করা হলো না।’
শিক্ষা সংস্কার নিয়ে গবেষণা জরুরি উল্লেখ করে তিনি বলেন, “গত অক্টোবরে প্রকাশিত উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলে ইংরেজি ও আইসিটির মতো এমন গুরুত্বপূর্ণ দুটি বিষয়ে এভাবে অকৃতকার্য হতে থাকলে বর্তমানে ‘এআই’ যুগের এই প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে টিকে থাকা সম্ভব কি না—এই প্রশ্নটিও রাখলাম। তবে আমি মনে করি, বর্তমান গ্লোবাল ভিলেজে শিক্ষাদীক্ষায় টিকে থাকতে হলে আমাদের ‘তথাকথিত গণভোট’ নিয়ে গবেষণার পরিবর্তে শিক্ষা সংস্কার নিয়ে গবেষণা সবচেয়ে বেশি জরুরি।”
গণভোটের চেয়ে আলুর ন্যায্যমূল্য পাওয়া বেশি গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে তারেক রহমান বলেন, “দেশে এবার এক কোটি ১৫ লাখ টন আলু উৎপাদিত হয়েছে। আলু উৎপাদন করে কৃষকরা মনে হয় বিপাকে পড়েছেন। আলু চাষিরা এবার প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা লোকসানের আশঙ্কা করছেন। অন্যদিকে আমরা যদি দেখি, দু-একটি রাজনৈতিক দলের আবদার মেটাতে কথিত অকারণ গণভোট করতে হলেও রাষ্ট্রকে প্রায় সমপরিমাণ টাকা গচ্চা দিতে হবে। এমন পরিস্থিতিতে লোকসানের মুখোমুখি এসব আলু চাষির কাছে এই সময়ে ‘গণভোট’-এর চেয়ে আলুর ন্যায্যমূল্য পাওয়া বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে আমি মনে করি।”
তিনি আরো বলেন, “দেশে চাহিদার চেয়েও বেশি পেঁয়াজ উৎপাদনের সক্ষমতা কৃষকদের রয়েছে। তবে পেঁয়াজ সংরক্ষণের সুষ্ঠু ব্যবস্থা না থাকায় প্রতিবছর পেঁয়াজ আমদানির ওপর নির্ভর করতে হয়। আমার কাছে মনে হয়, জনগণের হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে কথিত ‘গণভোট উৎপাদনের’ চেয়ে সেই টাকায় পেঁয়াজ সংরক্ষণাগার স্থাপন কৃষকদের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য।”
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, ‘পলাতক লুটেরা বাহিনীর বেপরোয়া লুটপাটের পর দেশের ব্যাংকিং সেক্টর এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। দেশের কমপক্ষে ২৪টি ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে। জনগণকে ভয় দেখতে চাই না, তবে আমাদের সতর্ক থাকা প্রয়োজন—দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে নাজুক হয়ে উঠছে। জিডিপির প্রবৃদ্ধি আশানুরূপ নয়।’
২০০৬ সালের জিডিপির তথ্য উল্লেখ করে তারেক রহমান বলেন, ‘২০০৬ সালে বিএনপি সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে রাষ্ট্রক্ষমতা হস্তান্তর করার সময় দেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৭.৬ পার্সেন্ট। এরপর আর কোনো সরকারের পক্ষেই সেই রেকর্ড অতিক্রম করা সম্ভব হয়নি। বর্তমানে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৪ শতাংশেরও কম।’
রাজপথের আন্দোলনের সঙ্গীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি বলেন, “এ কথাটি আমি এর আগেও একবার বলেছিলাম। উত্তর কোরিয়ার সংবিধানে লেখা রয়েছে ‘ডেমোক্রেটিক পিপল’স রিপাবলিক অব কোরিয়া’। সংবিধানে লেখা থাকলেই সবকিছু নিশ্চিত হয়ে যায় না। আসলে সবার আগে প্রয়োজন রাষ্ট্র, রাজনীতি সম্পর্কে মোনাফেকি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। প্রয়োজন মানসিকতার পরিবর্তন। প্রয়োজন রাজনৈতিক সমঝোতার। প্রয়োজন গণতান্ত্রিক মানসিকতা। সর্বোপরি প্রয়োজন দেশপ্রেম এবং জাতীয় ঐক্য।” আলোচনাসভায় তারেক রহমান স্বাধীনতার ঘোষকের একটি কথা সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘তিনি বলেছিলেন, জাতীয় ঐক্য আমাদের শক্তি—বিভাজন আমাদের দুর্বলতা।’
‘দিল্লি নয়, পিন্ডি নয়, নয় অন্য কোনো দেশ—সবার আগে বাংলাদেশ’—এই স্লোগান উচ্চারণ করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তাঁর বক্তব্য শেষ করেন।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আব্দুুল মঈন খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহউদ্দিন আহমদ, বেগম সেলিমা রহমান, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহম্মদ বীরবিক্রম, অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ, অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মাহবুব, এলডিপি চেয়ারম্যান ড. কর্নেল অলি আহমদ বীরবিক্রম। সঞ্চালনা করেন বিএনপির প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু ও বিএনপি কেন্দ্রীয় কমিটি সদস্য সাত্তার পাটোয়ারী।
রুপসীবাংলা৭১/এআর

