রুপসীবাংলা৭১ অন্যান্য ডেস্ক : প্রযুক্তিনির্ভর বর্তমান বিশ্ব এমন এক মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে, যেখানে মানবিক বোধ ও যান্ত্রিক প্রজ্ঞার মধ্যে সূক্ষ্ম এক প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। অ্যালগরিদমের নিখুঁত যুক্তি, মেশিনের নির্ভুল সিদ্ধান্ত আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অজস্র ডেটাভিত্তিক বিশ্লেষণ। এসবে মনে হয় মানুষ যেন নিজের সৃষ্টির ছায়াতেই হারিয়ে যাচ্ছে। মানব সৃষ্টির প্রকৃতি আর সৃষ্টির সেরা জীবের মনোদৈহিক সত্তা নিয়ে চিন্তা করা হৃদয়ে প্রশ্ন জাগে যে এই কৃত্রিম জগতের মাঝে মানব আত্মার স্থান কোথায়? মানুষও কি ডেটা, যুক্তি আর কোডের সমষ্টি? নাকি মানুষ এমন এক অনির্ণেয় সত্তা, যার ভেতরে আল্লাহর ফুৎকার দেওয়া রুহের ছোঁয়া আছে? আল্লাহ প্রদত্ত নূরের অবর্ণনীয় শক্তি আছে?
কোরআনের ঘোষণায় মানুষের মর্যাদা
মহান আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে মানুষ সম্পর্কে ঘোষণা দিয়েছেন, ‘যখন আমি তাকে সুঠাম করব এবং তার মধ্যে নিজ আত্মার অংশ ফুঁকে দেব, তখন তোমরা তার প্রতি সিজদাবনত হও।
’(সুরা : হিজর, আয়াত : ২৯)
এই আয়াত মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের মূল চাবিকাঠি। অ্যালগরিদম লিখে একজন প্রোগ্রামার, কিন্তু মানুষকে সৃষ্টি করেছেন স্বয়ং আল্লাহ। অ্যালগরিদমের যুক্তি সীমিত ডেটার মধ্যে আবদ্ধ, অথচ মানুষের আত্মা এমন এক সত্তা, যা আল্লাহর আদেশের সঙ্গে সংযুক্ত। সেই আত্মাই তাকে চেতনা, বিবেক ও নৈতিকতা দিয়েছে।
যার সীমা-পরিসীমা নির্ধারণ করেন মহান আল্লাহ। কাউকে এমন উদ্যমতা ও চিন্তাশক্তি দান করেন যে সে অ্যালগরিদম তৈরি করে, যাকে বাহ্যিক দৃষ্টিতে মানককুলের প্রতিপক্ষ মনে হয়। আবার কাউকে নিজের ভালো-মন্দ বোঝার চিন্তা করার মতো অবস্থায়ও রাখেন না।
পবিত্র কোরআনের অন্য এক স্থানে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আমি আদম সন্তানদের মর্যাদা দান করেছি।
’ (সুরা : ইসরা, আয়াত : ৭০)
এই মর্যাদা কোনো যান্ত্রিক বা গণনাগত নয়, বরং আধ্যাত্মিক ও নৈতিক। তাই মানুষ যখন যন্ত্রের হাতে নিজের সিদ্ধান্ত ছেড়ে দেয়, তখন সে তার নিজস্ব মর্যাদাকে খর্ব করে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় মানব বুদ্ধির বিস্তার নাকি প্রতিদ্বন্দ্বী?
ইসলামী দর্শনে ‘আকল’ (বুদ্ধি) মানুষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিয়ামত। মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই এতে চিন্তাশীলদের জন্য নিদর্শন রয়েছে।’ (সুরা : রূম, আয়াত : ২৪) অর্থাৎ বুদ্ধি মানুষের জন্য একটি ‘ঈমানের প্রমাণ’।
কিন্তু সেই বুদ্ধিই যখন মেশিনে স্থানান্তরিত হয়, তখন তা আত্মাহীন হয়ে পড়ে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) মানুষের বুদ্ধির অনুকরণ করতে পারে, কিন্তু ‘আত্মার আলোক’, যা আল্লাহর পক্ষ থেকে দানকৃত নূর। তা অনুকরণ করতে পারে না।
ইমাম গাজালি (রহ.) তাঁর ইহইয়া উলুমুদ্দীন গ্রন্থে লিখেছেন, ‘জ্ঞান ও বুদ্ধির আলো তখনই পূর্ণতা পায়, যখন তা আত্মার আলোয় মিলিত হয়।’ অর্থাৎ নিছক যুক্তি মানুষের পূর্ণ পরিচয় দিতে পারে না; সেখানে নৈতিকতা, রহমত ও খোদাভীতি আবশ্যক।
আজকের অ্যালগরিদমভিত্তিক পৃথিবীতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ডেটার ওপর। কে বেশি ক্লিক করেছে, কে বেশি পছন্দ করেছে। কিন্তু কোরআনের দৃষ্টিতে সঠিক সিদ্ধান্ত নির্ভর করে তাকওয়ার ওপর।
মহান আল্লাহ বলেন ‘তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সর্বাধিক মর্যাদাবান সে-ই, যে সবচেয়ে বেশি তাকওয়াবান।’
(সুরা : হুজুরাত, আয়াত : ১৩)
অ্যালগরিদম তাকওয়া বোঝে না, বোঝে শুধু পরিসংখ্যান। তাই বলা যায়, অ্যালগরিদম মানুষের ‘মূল্য’ নয়, বরং ‘প্রবণতা’ মাপে। যেখানে সত্য ও নৈতিকতার চেয়ে জনপ্রিয়তা বড় হয়ে ওঠে।
আত্মা ও নৈতিকতার প্রশ্নে অ্যালগরিদমের সীমাবদ্ধতা
হাদিসে মহানবী (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ তোমাদের চেহারা ও সম্পদের দিকে তাকান না, বরং তোমাদের অন্তর ও আমলের দিকে তাকান।’ (মুসলিম, হাদিস : ২৫৬৪)
এই হাদিস স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয় যে মানব সত্তার মাপকাঠি দৃশ্যমান তথ্য নয়, বরং অদৃশ্য অন্তর। অথচ অও সিস্টেম শুধু দৃশ্যমান তথ্য বিশ্লেষণ করে। মানুষের অন্তর, নিয়ত, ও খোদাভীতি তার ডেটাসেটে অনুপস্থিত। ফলে এক অর্থে, আধুনিক অ্যালগরিদম এক আত্মাহীন বিচারক। যার সিদ্ধান্তে নেই দয়া, নেই মাগফিরাহ, নেই নৈতিক সূক্ষ্মতা।
ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) লিখেছেন, ‘আত্মা হলো সেই আলো, যা আল্লাহর প্রেমে আলোকিত হয়। যখন তা নিভে যায়, তখন মানুষ যন্ত্রে পরিণত হয়।’ (আল-রুহ)
আজ সেই ভয়াবহ বাস্তবতা আমরা দেখছি, মানুষ যেন আত্মাহীন যন্ত্রের মতো নিজের অ্যালগরিদমিক ছন্দে নাচছে। সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের চিন্তা, অনুভূতি ও রুচি পর্যন্ত নির্ধারণ করছে। অথচ ইসলাম চায় আত্মসচেতনতা, নিজের বিবেক ও খোদাভীতির জাগরণ।
ইসলামী নৈতিকতা বনাম অ্যালগরিদমিক ন্যায়
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখন বিচারব্যবস্থা, নিয়োগপ্রক্রিয়া, এমনকি যুদ্ধের ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কোনো যন্ত্র কি ন্যায়বিচার বুঝতে পারে? ইসলাম বলে, ন্যায় শুধু বাহ্যিক সমতা নয়, বরং প্রসঙ্গভিত্তিক করুণা ও বিবেকের ভারসাম্য। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ আদেশ দেন ন্যায়বিচার ও উত্কৃষ্ট আচরণের।’
(সুরা : নাহল, আয়াত : ৯০)
‘ইহসান’ মানে শুধু হিসাব নয়, বরং দয়ার নৈতিকতা। AI বা অ্যালগরিদমের কাছে ‘ইহসান’ অজানা একটি ধারণা। সেখানে করুণা নেই, শুধুই ফলাফল। তাই ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে অ্যালগরিদমিক ন্যায়বিচার আংশিক সত্য হলেও প্রকৃত ইহসান কিছুতেই সম্ভব নয়। কারণ এতে হৃদয় অনুপস্থিত।
মানুষ : এক অ্যালগরিদমের অতীত সত্তা
আল-ফারাবি তাঁর দর্শনে মানুষকে ‘বিবেক ও নৈতিক আত্মার যুগল সত্তা’ বলেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, জ্ঞান শুধু তখনই মানবিক হয়, যখন তা ঈমান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, অন্যথায় জ্ঞান বিপর্যয়ের উৎস।
কোরআন এই সত্যকেই স্মরণ করিয়ে দেয়, ‘আল্লাহ মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন, যা সে জানত না।’ (সুরা : আলাক, আয়াত : ৫)
এই শিক্ষার উৎস আল্লাহ; অ্যালগরিদমের উৎস মানুষ। তাই মানুষ কখনো তার সৃষ্ট যন্ত্রের দাস হতে পারে না।
মানুষের মধ্যে এমন কিছু আছে, যা কোনো মেশিন অনুকরণ করতে পারবে না। যেমন— আত্মা, নৈতিকতা ও রহমত।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের যুক্তিকে অনুকরণ করতে পারে, কিন্তু তার ‘রুহ’ বা আত্মাকে নয়।
যখন মানবতা প্রযুক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করে, তখন তার চিন্তা হয় নিঃস্ব, তার অনুভূতি হয় নির্বাসিত।
ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের প্রকৃত শ্রেষ্ঠত্ব তার ঈমান, তাকওয়া ও আল্লাহভীতিতে। যেখানে যন্ত্র গণনা করে, মানুষ সেখানে দোয়া করে। যেখানে অ্যালগরিদম বিশ্লেষণ করে, মানুষ সেখানে ক্ষমা করে। এটাই পার্থক্য, আর এই পার্থক্যই মানুষকে ‘আল্লাহর প্রতিনিধি’ বানায়।
অতএব, কৃত্রিম জগতের ভেতরেও আত্মার এই আলোক শিখা জ্বালিয়ে রাখাই মানুষের শ্রেষ্ঠ দায়িত্ব। এটাই ঈমানের ঘোষণা যে ‘আমি অ্যালগরিদম নই, আমি আল্লাহর সৃষ্ট এক আত্মাধারী মানুষ।’
রুপসীবাংলা৭১/এআর

