নিজস্ব প্রতিনিধি :জাতীয় প্রেসক্লাব, তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হল (ভিআইপি লাউঞ্জ), ঢাকা
তারিখ: ১৪ অক্টোবর ২০২৫, মঙ্গলবার, সকাল ১০টা
আয়োজনে: বাংলাদেশ রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটি
বাংলাদেশ রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটির উদ্যোগে জাতীয় প্রেসক্লাবের তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে “বাংলাদেশ রেলওয়ের চলমান অবস্থা, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও পোষ্যদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা, নিয়োগে স্বচ্ছতা ও দুর্নীতি প্রতিরোধ, টিএলআর ও প্রকল্পের গেইট কিপারদের চাকরি স্থায়ীকরণ, ইঞ্জিন-কোচ সংকট মোকাবিলা, রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর রেশনিং ব্যাবস্থা ও ঝুঁকি ভাতা প্রদান,অ্যাটেনডেন্ট পদসহ সকল পদে আউটসোর্সিং এ জনবল নিয়োগ বাতিলের দাবি” শীর্ষক সংলাপ ও সাংবাদিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটির সভাপতি মোঃ মনিরুজ্জামান মনির।
সংলাপে উপস্থিত ছিলেন
১- জনাব আনোয়ার হোসেন, সভাপতি-বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলে
২- এম. আর. মঞ্জু, সাধারণ সম্পাদক, জাতীয়তাবাদী রেলওয়ে শ্রমিক কর্মচারী দল।
৩- এস. কে. বারি, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ রেলওয়ে কারিগর পরিষদ।
৪- মোঃ ইউছুফ রশীদি উপদেষ্টা বাংলাদেশ রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটি কেন্দ্রীয় কমিটি
এছাড়াও রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটির কেন্দ্রীয় ও জেলা কমিটির নেতৃবৃন্দ, বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়নের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ এবং জাতীয় পর্যায়ের শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন।
আলোচ্য বিষয়সমূহ ও মূল বক্তব্যসমূহ:

১. বাংলাদেশ রেলওয়ের চলমান অবস্থা ও করণীয়:
বক্তারা বলেন, একসময় দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় সেবাখাত ছিল রেলওয়ে। অথচ আজ এটি প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা, জনবল সংকট, ইঞ্জিন- কোচ ঘাটতি, ও নীতিগত অনিশ্চয়তা, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী এবং তাদের পরিবার আজও ন্যায়সংগত নিয়োগ পদোন্নতি, ও সামাজিক সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত, রেলওয়ে ভূমি ও সম্পদের অপব্যবহার ও দ্বৈত নেতৃত্ব কাঠামো কার্যত সিদ্ধান্ত সুষ্ঠ রেলওয়ে পরিচালনা জটিল করে তুলছে। রেলওয়ে পুনরুজ্জীবনে প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবস্থাপনা, যোগ্য নেতৃত্ব এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন বলে সবাই মত দেন।
২. কর্মকর্তা-কর্মচারী ও পোষ্যদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা — রাষ্ট্রের দায়িত্ব, উপহার নয়:
রেলওয়ে কর্মচারী ও তাদের পরিবার আজ বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার। বক্তারা জোর দিয়ে বলেন—ন্যায্য অধিকার কোনো দয়া নয়, এটি রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। বিশেষ করে পোষ্য পরিবারগুলোর প্রতি রাষ্ট্রের নৈতিক ও আইনি দায়বদ্ধতা রয়েছে।
৩. নিয়োগ বিধিমালা ২০২০ সংশোধন এর জন্য কমিটি গঠনের পরেও কি জনবল নিয়োগ বৈধ:
২০২০ বিধিমালার মাধ্যমে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অস্পষ্টতা ও জটিলতা তৈরি হয়েছে। অনেক নিয়োগপ্রাপ্তদের পদ প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। বক্তারা বলেন, সংশোধন কমিটি গঠনের পরেও পূর্বের বিধিমালা ব্যবহার “মালাফাইড ইন্টেন্ট( ইচ্ছাকৃত অবিচার) হিসাবে গণ্য হতে পারে এবং আদালতে চ্যালেঞ্জযোগ্য। কমিটি গঠনের প্রমাণ থাকলে পূর্বের বিধিমালার কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ হয় এবং স্টে অর্ডার বা বাতিলের ঝুঁকি থাকে। আদালতের নির্দেশনা এবং সংবিধানের ২৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, নিয়োগে স্বচ্ছতা ও সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।
৪. কর্তব্যরত অবস্থায় মৃত্যুবরণকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীর পোষ্যদের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির পদে সরাসরি নিয়োগ: মানবিক ও ন্যায়ভিক্তিক দায়িত্ব রাস্ট্রেরঃ
রেলওয়ে পরিবারে প্রায়ই কর্মরত অবস্থায় মৃত্যুবরণকারী কর্মচারীর পরিবার জীবিকা হারিয়ে চরম দুর্দশায় পড়ে। বক্তারা বলেন—তাদের পোষ্যদের সরাসরি নিয়োগ দেওয়া রাষ্ট্রের মানবিক ও ন্যায়ভিত্তিক দায়িত্ব, কোনো উপকার নয়। কেন এটি রাস্ট্রের দায়িত্ব – সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫ প্রতিটি নাগরিকের জীবিকা ও সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা রাস্ট্রের দায়িত্ব। এটি ন্যাচারাল জাস্টিস( স্বাভাবিক ন্যায়) যে পরিবার একজন কর্মচারীর জীবন দিয়ে রেলকে সেবা করছে, তার পরিবার বাচানো নৈতিক দায়িত্ব। রেলওয়ে কেবল স্টেশন, ইঞ্জিন বা ট্রেন নয় – এটি রেলওয়ে কর্মচারীদের ত্যাগের ওপর দাড়িয়ে থাকা একটি পরিবার। সেই পরিবারের কেউ কর্তব্যরত অবস্থায় শহীদ হলে তার সন্তানকে যদি চাকরি না দেওয়া হয় – তাহলে রেলওয়ের বিবেক কোথায়?
৫. অডিট আপত্তি ও রেলওয়ের কর্মকর্তাদের নামে বিভ্রান্তিকর সংবাদ প্রচারের বিরুদ্ধে করণীয়:
বাংলাদেশ রেলওয়ে একটি জটিল প্রশাসনিক কাঠামোর প্রতিষ্ঠান, যেখানে প্রকল্প, ত্রুয়,রক্ষণাবেক্ষণ এবং পরিচালনা কাজে নিয়মিত অডিট আপত্তি দেখা দেয়। “অডিট আপত্তি মানেই দূর্নীতি বা আত্মসাৎ নয়” অথচ এই অডিট আপত্তি নিয়ে কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যমূলক সংবাদ প্রচার করা হয় যা প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করে। বক্তারা জোর দিয়ে বলেন, “অডিট আপত্তি-দূর্নীতি নয়” অধিকাংশ অডিট আপত্তি নিষ্পত্তিযোগ্য। তদন্তের আগেই ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে সংবাদ প্রচারের কারণে স্বাভাবিক ব্যাখ্যার সুযোগ নষ্ট,ন্যায় বিচার বিঘ্নিত, কর্মকর্তা হেনস্তা, সামাজিক অপমান এবং জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। কাজেই রেলওয়ের সম্পর্কে অসত্য প্রচারের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হোক। রেলওয়ে কতৃপক্ষের উচিত একদিকে স্বচ্ছতা বজায় রাখা, অন্যদিকে কর্মকর্তাদের অবিচারমূলক প্রচার থেকে সুরক্ষা দেওয়া।
৬. ইঞ্জিন সংকট ও ব্যবস্থাপনা দুর্বলতা: করণীয় কি–
রেলওয়ে বর্তমানে তীব্র ইঞ্জিন সংকটে ভুগছে, যার ফলে অনেক রুটে ট্রেন চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। বক্তারা বলেন, রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থার দুর্বলতা, যন্ত্রাংশ আমদানিতে বিলম্ব ও পরিকল্পনার অভাবে এই সংকট তৈরি হয়েছে। জরুরি ভিত্তিতে মেরামত ও ইঞ্জিন ক্রয় প্রক্রিয়া স্বচ্ছ করা প্রয়োজন। ইঞ্জিন সংকট শুধুই যন্ত্রের অভাব নয়- এটি একটি “ম্যানেজমেন্ট ফেইলিউর”। রেলওয়ের ইঞ্জিন কিনে টিকিয়ে রাখা যাবে না,বুদ্ধিমান রক্ষণাবেক্ষণ ও জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থাপনা ছাড়া এ খাত টিকবে না।
৭. রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য রেশনিং ব্যবস্থা ও ঝুঁকি ভাতা প্রদান: কেন এখনই প্রয়োজন
বক্তারা জানান, রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা জীবনবাজি রেখে কাজ করছেন, কিন্তু তারা এখনো সরকারি রেশন বা ঝুঁকি ভাতা থেকে বঞ্চিত। বক্তারা এই বৈষম্য দূর করে তাদের জন্য ন্যায্য প্রাপ্য নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়ে বলেন– এখনই সময় রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য রেশনিং ব্যাবস্থা ও ঝুঁকি ভাতা বাস্তবায়নে সরকারকে দ্রত পদক্ষেপ নিতে হবে। এটি শুধু একটি কল্যাণমূলক উদ্যোগ নয়- এটি একটি জাতীয় নিরাপত্তা বিনিয়োগ, যা দেশের মানুষকে আরও নিরাপদ ও আত্মবিশ্বাসী করবে
৮. সংশোধনাধীন নিয়োগ বিধিমালার প্রয়োগের বৈধতা প্রশ্ন
সংশোধন প্রক্রিয়া চলমান থাকা অবস্থায় বিধিমালা প্রয়োগের ঘটনা আইনগতভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। বক্তারা বলেন, এটি প্রশাসনিক শৃঙ্খলা ও ন্যায্য নিয়োগের পরিপন্থী। তারা বলেন- রেলওয়ে যদি সত্যিই স্বচ্ছতা ও যোগ্যতা ভিত্তিক নিয়োগ নিশ্চিত করতে চায়- তবে ২৭ ডিসেম্বর /২১ এ গঠিত সংশোধনী কমিটির অস্তিত্ব অস্বীকার করে ত্রুটিপূর্ণ বিধিমালা দিয়ে নিয়োগ চালানো যাবে না। এটি কোনো ভাবেই স্বচ্ছতা নয়- বরং এটি ” নিয়োগের গায়েবি রাজনীতি “।
৯. কর্মচারীবান্ধব নিয়োগ বিধিমালা প্রণয়ন: সময়োপযোগী পদক্ষেপ
বক্তারা বলেন, রেলওয়ে কর্মচারী নিয়োগ বিধিমালা ২০২০ সংশোধন করে কর্মচারী ও পোষ্যবান্ধব নতুন বিধিমালা প্রণয়ন করতে হবে যাতে যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা এবং মানবিক বিবেচনা যথাযথভাবে প্রতিফলিত হয়। রেলওয়ে কর্মচারী বান্ধব নিয়োগ বিধিমালা প্রণয়ন ছাড়া প্রতিটি নিয়োগই ঝুঁকিপূর্ণ, অস্বচ্ছ ও অসাংবিধানিক প্রমাণিত হবে।
১০. সংশোধন কমিটি গঠন সত্ত্বেও নিয়োগ বদলি ও পদোন্নতি চলমান রাখা আইন ভঙ্গের আশংকা:
নিয়োগ বিধিমালা সংশোধনের জন্য কমিটি গঠনের পরও নিয়োগ ও বদলি প্রক্রিয়া চালু রাখাকে বক্তারা প্রশাসনিক অসঙ্গতি হিসেবে উল্লেখ করেন। তাঁরা বলেন, এতে আইনি জটিলতা ও স্বজনপ্রীতির সুযোগ বাড়ছে। কমিটি গঠন করার পরও পূর্বের বিধিমালা অনুযায়ী নিয়োগ বদলী পদোন্নতি চালানো অবৈধ ও অসাংবিধানিক, যা স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
১১. অপেক্ষমাণ তালিকার নামে নিয়োগ বাণিজ্য বন্ধ:
অপেক্ষমাণ তালিকার নামে নিয়োগ বাণিজ্য একটি নতুন দুর্নীতির রূপ নিয়েছে বলে বক্তারা মন্তব্য করেন। তাঁরা বলেন, সব নিয়োগে প্রকাশ্য বিজ্ঞপ্তি ও লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে মেধা যাচাই করা হোক।
১২. টিএলআর ও প্রকল্পের গেইটকিপারদের চাকরি স্থায়ীকরণ:
দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা টিএলআর ও প্রকল্পের গেইটকিপাররা এখনও অস্থায়ী পদে রয়েছেন। বক্তারা বলেন, এদের চাকরি দ্রুত স্থায়ীকরণ না করলে মানবিক সংকট ও নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকি আরও বাড়বে। টিএলআর ও প্রকল্পের গেইট কিপারদের চাকরি স্থায়ী করা শুধু ন্যায্যতা নয়- এটি রেলওয়ের সেবা, নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক দক্ষতা নিশ্চিত করার একান্ত প্রয়োজন।
১৩. আউটসোর্সিং প্রক্রিয়া বাতিল ও নিয়োগ বিধিমালা থেকে আউটসোর্সিং ধারা অপসারণ ঃ
বক্তারা বলেন, রেলওয়ের অ্যাটেনডেন্ট পদে আউটসোর্সিং এর মাধ্যমে ঠিকাদার কতৃক জনবল নিয়োগের কারণে রেলওয়ে বছরে প্রায় ১০০ কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে। আউটসোর্সিং প্রক্রিয়ায় নিয়োগের ফলে কর্মসংস্থান অনিশ্চিত ও দুর্নীতিপূর্ণ হয়েছে। তাই এটি নিয়োগ বিধিমালা থেকে স্থায়ীভাবে অপসারণ করতে হবে।
সভায় বক্তাদের আহ্বানঃ
সভায় বক্তারা বলেন, রেলওয়ের এই সংকট কেবল প্রশাসনিক নয়—এটি একটি মানবিক ও নৈতিক সংকটও। রেলওয়ে কর্মচারীদের অধিকার, পোষ্যদের ভবিষ্যৎ এবং প্রতিষ্ঠানের টিকে থাকার জন্য সবার ঐক্য প্রয়োজন। তারা রেলওয়ে পুনর্গঠনে “ন্যায়ভিত্তিক সংস্কার ও মানবিক পুনর্জাগরণ আন্দোলন” গড়ে তোলার আহ্বান জানান।
সভাপতির বক্তব্যে মোঃ মনিরুজ্জামান মনির বলেন,
“বাংলাদেশ রেলওয়ে আজ শুধু চলাচলের মাধ্যম নয়—এটি লাখো পরিবারের জীবনের সঙ্গে জড়িত একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। তাই এর সংস্কার, স্বচ্ছতা, এবং মানবিক পুনর্গঠন আজ সময়ের দাবি।”
এই সংলাপ ও সাংবাদিক সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল রেলওয়ের ভবিষ্যৎ উন্নয়ন, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও পোষ্যদের ন্যায্য অধিকার রক্ষা, দুর্নীতি ও অনিয়ম প্রতিরোধে জাতীয় ঐক্য গঠন, এবং একটি দক্ষ, স্বচ্ছ ও মানবিক রেলওয়ে প্রশাসন প্রতিষ্ঠা।
সভা শেষে উপস্থিত সকল প্রতিনিধি রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটির নেতৃত্বে রেলওয়ের সংস্কার আন্দোলনে যুক্ত থাকার অঙ্গীকার করেন।

