রুপসীবাংলা৭১ অন্যান্য ডেস্ক : কক্সবাজার-বান্দরবান সীমান্তে মায়ানমার থেকে গরু পাচার নতুন কোনো বিষয় নয়। দীর্ঘদিন ধরেই এই পথে গরু, অস্ত্রসহ নানা চোরাচালানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে একাধিক চক্র। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত নাম ডাকাত শাহীন। যদিও তিনি এখন কারাগারে, তবুও অভিযোগ উঠেছে—সেখান থেকেই তিনি পুরো সিন্ডিকেট চালাচ্ছেন।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্যমতে, গত ৫ জুন রাতে যৌথ বাহিনীর অভিযানে নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত এলাকা থেকে শাহীনকে গ্রেপ্তার করা হয়। অভিযানে তার কাছ থেকে উদ্ধার হয় অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র, ৩১টি বার্মিজ গরু ও একটি ছাগল। এরপর তার আস্তানা থেকে উদ্ধার হয় বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গুলি। তদন্তে বেরিয়ে আসে, গরু পাচার ছাড়াও সীমান্ত এলাকায় অস্ত্র, মাদক ও চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত একটি শক্তিশালী চক্রের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তিনি।
শাহীন গ্রেপ্তার হলেও থামেনি তার সিন্ডিকেট। তদন্তকারীদের দাবি, কারাগার থেকেই শাহীন সীমান্তে গরু চোরাচালানের নির্দেশনা দিচ্ছেন। তার হয়ে মাঠপর্যায়ে কাজ করছে অন্তত ২২ জনের একটি চক্র। এই চক্রের নেতৃত্বে উঠে এসেছে নিরুপম শর্মা নামের এক ব্যক্তি, যার নেতৃত্বে সীমান্তের চোরাপথে আবারও গরু আসা শুরু হয়েছে।
মাঠ পর্যায়ের মূল দায়িত্বে ছিল নুরুল আবছার ওরফে ডাকাত আবছার, যিনি কিছুদিন আগে অস্ত্রসহ বিজিবির হাতে গ্রেপ্তার হন। তবে তার আগে থেকেই সিন্ডিকেট গরু পাচারের বিরুদ্ধে বিজিবির অভিযানের প্রতিবাদে আদালতে পাল্টা মামলা দিয়ে বিতর্ক তৈরি করে।
জানা যায়, শাহীন-আবছার চক্র গরুগুলো ফেরত পেতে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে। অথচ জব্দ হওয়া গরুগুলো আদালতের নির্দেশে নিলামে বিক্রি হয়ে সরকারি কোষাগারে জমা হয়েছে।
স্থানীয় একাধিক সূত্র বলছে, শাহীন একসময় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের ছত্রছায়ায় থাকলেও পরবর্তীতে বিএনপির প্রভাবশালীদের সঙ্গেও সম্পর্ক গড়ে তোলেন।
রাজনৈতিক লবিংয়ের কারণে তিনি দীর্ঘদিন প্রশাসনের নজরদারি এড়িয়ে গেছেন।
বিজিবির রামু সেক্টরের এক কর্মকর্তা জানান, শাহীন এখনো তার চক্রের মাধ্যমে সীমান্তে গরু পাচার চালিয়ে যাচ্ছে। চক্রের সদস্যরা স্থানীয় দালাল মাসুদ, নিরুপম শর্মাদের সঙ্গে মিলে নিয়মিত চোরাপথে গরু পার করছে। এই সিন্ডিকেটের অনেকে একাধিক মামলার আসামি হলেও এখনো প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। চোরাচালান থেকে অর্জিত অর্থে তারা সীমান্ত এলাকায় বাড়ি, গাড়ি, জমি ও ব্যবসা গড়ে তুলেছে।
গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যমতে, শাহীন তার জামিন নিশ্চিত করতে রাজধানীতে বড় অঙ্কের টাকা ছড়াচ্ছেন। একইসঙ্গে যদি জামিনে মুক্তি সম্ভব না হয়, তাহলে মামলার প্রমাণ দুর্বল করতে ভুয়া সাক্ষী, নথিপত্র ও ‘মানবিক’ ইমেজ প্রচারের কৌশল নিয়েছেন। বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে তার বিতরণকৃত ত্রাণ, এলাকার মানুষের সঙ্গে ছবি—যাতে তাকে ‘দরদি মানুষ’ হিসেবে দেখানো হচ্ছে।
বিষয়টি নিয়ে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) এমদাদুল হক বলেন, ‘সীমান্তে চোরাচালান বন্ধ করতে গেলে প্রথমেই বাধা আসে এসব চক্রের অপপ্রচার থেকে। প্রশাসন অভিযান চালালে তারা মামলা-মোকদ্দমা দিয়ে চাপ তৈরি করে। এতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মনোবল ভেঙে যায়, অপরাধীরা সেই সুযোগে আবার সংগঠিত হয়।’
বিজিবির রামু সেক্টরের কমান্ডার কর্নেল মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘শাহীন সিন্ডিকেটের সক্রিয় সদস্যদের তালিকা আমাদের হাতে আছে। তাদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। ইতিমধ্যে সীমান্তে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।’ তিনি আরো জানান, ‘শাহীনকে গ্রেপ্তারের পর কিছুদিন চোরাচালান বন্ধ থাকলেও এখন আবার নতুন নেতৃত্বে সক্রিয় হয়েছে। তবে আমরা গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে দ্রুত ব্যবস্থা নিচ্ছি।’
এদিকে স্থানীয়রা বলছেন, সীমান্তে চোরাচালান বন্ধ করতে হলে কেবল চক্রের পোষা দালাল নয়, তাদের পেছনের রাজনৈতিক ও প্রভাবশালী মহলকেও আইনের আওতায় আনতে হবে। অন্যথায় শাহীনরা জেলে থেকেও সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ করবে, আর রাষ্ট্র হারাবে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব।
রুপসীবাংলা৭১/এআর