।। এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া।।
ব্যক্তিজীবনে ও সমাজে যেমন, রাজনীতিতেও এমন কিছু দাবানলের মত স্মৃতি থাকে যা সকল সময় জলন্ত হয়ে থাকে। যে সকল স্মৃতি কখনোই ভুলে যাওয়া যায় না, বা ভুলে থাকাও উচিত নয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এমন কিছু মানুষের জন্ম যারা রাজনীতিকে উজ্জল করেছে। যারা মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত আসলেই রাজনীতি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তেমনই একজন মানুষ হচ্ছেন শফিউল আলম প্রধান।
২০১৭ সালের ২১ মে, ভোর বেলায় একজন রাজনৈতিক সহযোদ্ধা বর্তমানে ১২ দলীয় জোটের সমন্বয়কারী, বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান এডভোকেট সৈয়দ এহসানুল হুদার ফোন পেয়েই ঘুম ভাঙ্গলো আমার। টেলিফোনের অপরপ্রান্ত থেকে হুদা ভাই বললেন ভাই তারা তারি বাসা থেকে বের হয়ে আসাদ গেইট চলে আসেন শফিউল আলম প্রধান তার দুনিয়ার সফর শেষ করে অনন্তকালের পথ চলে গেছেন। হঠাৎ ঘুমের ঘোড়ের মধ্যে কথাটা কেন জানি বিশ্বাস হচ্ছিল না। কারণ আগের দিন সন্ধ্যায়ই প্রধান ভাইয়ের সাথে মোবাইলে কথা হয়েছে অনেক সময় নিয়ে। ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চ দিবস উপলক্ষে ২৩ মে বাংলাদেশের ন্যাপ’র আলোচনা সভা কিভাবে করবো, কাকে কাকে আমন্ত্রন জানাচ্ছি ইত্যাদি ছিল আলোচনার বিষয়। তিনি ফারাক্কা লংমার্চ নিয়ে ১৬ মে আমার লেখা প্রকাশিত প্রবন্ধ নিয়েও কথা বললেন।
অনেকটা কিংকর্তব্যবিমুর অবস্থায় রংপুরের নীলফামারীর ডিমলা থেকে আমার দলীয় প্রধান অর্থাৎ বাংলাদেশ ন্যাপ চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গানির ফোন। তিনি শুধু বললেন আপনি চলে যান আসাদ গেইট, যা যা করার দরকার করেন। আমি সন্ধ্যার মধ্যেই ঢাকা আসছি। তখন বিষয়টা পরিষ্কার হলো আমার কাছে। কারণ প্রধান ভাইয়ের সাথে জেবেল রহমান গানি, সৈয়দ এহসানুল হুদা বা আমার বয়সের পার্থক্য অনেক থাকলেও সম্পর্কটা ছিল অত্যান্ত কাছের ও আন্তরিকতার। মোবাইল করার সাথে সাথে অপরপ্রান্ত থেকে ভরাট গলায় বলে উঠতেন বলো হ্যালো কমরেড, কেমন আছো ?
আমি একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসাবে প্রায়শই কিছু লেখা লেখির চেষ্টা করতাম। যে পত্রিকায়ই লেখাটা প্রকাশিত হোক না কেন সর্বপ্রথম ফোনটি পেতাম শফিউল আলম প্রধানের। আর একটি ফোন আসতো তিনি হলেন শেখ শওকত হোসেন নিলুর। আমাদের তথাকথিত জাতীয়তাবাদী রাজনীতিক নেতা বা কর্মী বা সমর্থকরা সাধারণত লেখা লেখি পড়ার চেষ্টা করেন খুবই কম। কিন্তু, প্রধান ভাই ও নিলু ভাই দুজনেই পড়তেন এবং যিনি বা যারাই লেখালেখি করতে তাদের উৎসাহ দিতে কুন্ঠিত হতেন না। লেখার মধ্যে মতপার্থক্য থাকলে তা নিয়েও আলোচনা করতেন। ৮০-৯০ দশকে প্রধান-নিলু জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে প্রচন্ড রকমের জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। প্রধান-নিলু একটি রাজনৈতিক জুটিও ছিল রাজনীতিতে। কাকতালিয়ভাবে দুই জনের মৃত্যু একই সালে একই মাসে মাত্র ১৫ দিনের ব্যবধানে। অর্থ্যাৎ ২০১৭ সালের ৬ মে ইন্তেকাল করেন শেখ শওকত হোসেন নিলু। যদিও এই সময়টাতে প্রধান- নিলু রাজনীতির অবস্থান ছিল দুই প্রান্তে অবস্থান করছিলেন।
জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি-জাগপার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি শফিউল আলম প্রধানের জন্ম ১৯৫০ সালে পঞ্চগড়ে। তার বাবা গমিরউদ্দিন প্রধান ছিলেন বরেণ্য রাজনীতিক। তিনি পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের স্পিকার ছিলেন। মুত্যুকালে তিনি স্ত্রী অধ্যাপিকা রেহানা প্রধান, মেয়ে ব্যারিস্টার তাহমিয়া প্রধান, ছেলে ইঞ্জিনিয়ার রাশেদ প্রধানকে রেখে গেছেন।
বাবা মুসলিম লীগের রাজনীতি করায় প্রধান পরিবারে রাজনৈতিক আবহে বেড়ে উঠেন। পুরান ঢাকার বোরহানউদ্দিন কলেজে পড়ার সময় তিনি ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগে লেখাপড়ার সময় আওয়ামী লীগের সহযোগি সংগঠন ছাত্রলীগের গুরুত্বপূর্ণ নের্তৃত্বে অসীন হন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ছাত্রলীগ দুই ভাগে বিভক্ত হলে তিনি শেখ ফজলুল হক মনির অনুসারী হিসেবে আওয়ামী ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭৪ সালের ৪ এপ্রিল ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মুহসীন হলে সেভেন মার্ডারে তাকে প্রধান আসামী করা হয়। এ ঘটনাকে শফিউল আলম প্রধানের অনুসারীরা রাজনৈতিক চক্রান্ত দাবি করলেও বঙ্গবন্ধুর আমলেই তার মৃত্যুদন্ডাদেশ আসে। পঁচাত্তর পরবর্তী রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। জেল থেকে মুক্তি পেয়ে জিয়াউর রহমানের সময়ে ১৯৮০ সালের ৬ এপ্রিল রমনা গ্রিনে জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা) গঠন করেন।
এই জাগপার ব্যানারে তিনি দেশ মাটি ও মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়েন। দেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি রাজপথে ছিলেন। দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, তিস্তার পানি, টিপাইমুখে বাঁধের বিরোধিতা, সীমান্ত হত্যা ইত্যাদি ইস্যু নিয়ে বছরের পর বছর আন্দোলন করেছেন। এ জন্য প্রতিটি সরকারের শাসনামলেই তাকে কারাগারে যেতে হয়েছে। গণমানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে রাজনীতি করতে গিয়ে কারাবরণ করেন এ জন্যই মেয়েকে ব্যারিষ্টারী পড়িয়েছেন।
৬৯’র গণঅভ্যূত্থান, ৭১’র স্বাধীনতা সংগ্রাম, ৯০’র স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনসহ প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে রাজপথে লড়াকু ভূমিকা পালন করেন। গণমানুষের বিভিন্ন অধিকার আদায়ের দাবিতে প্রতিটি আন্দোলনে সক্রিয় থাকায় এই রাজনীতিবিদকে জাতি চিরদিন স্মরণ করবে। দেশের ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী জাতীয়তাবাদী ধারার রাজনীতি বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন শফিউল আলম প্রধান। তিনি দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সিংহপুরুষ হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
ই জাগপার ব্যানারে তিনি দেশ মাটি ও মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়েন। ভারতীয় আগ্রাসনবিরোধী এবং দেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি রাজপথের আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যার দাবি, দহগ্রাম আংগুরপোতা লংমার্চ, টিপাইমুখ বাঁধের বিরোধিতা, বেরুবাড়ী লংমার্চ, ইয়াসমিন হত্যা আন্দোলন, সীমান্ত হত্যাসহ নানাবিধ ইস্যু নিয়ে বছরের পর বছর আন্দোলন করেছেন। এ জন্য প্রতিটি সরকারের শাসনামলেই তাকে কারাগারে যেতে হয়েছে। সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম গ্রহণ করলেও দেশ-মাটি ও মানুষের অধিকার আন্দোলনের কারণে তিনি কঠিন জীবন পার করেছেন। আর দশটা সাধারণ মানুষের মতো সাধাসিদে জীবন যাপন করতেন।
শফিউল আলম প্রধানের রাজনীতির পথ চলা কতটুকু শুদ্ধ বা ভুল ছিল তা আগামী প্রজন্ম গবেষনা করবে। তবে, এতটুকু বলতে পারি প্রধান ভাই আপাতমস্তক একজন সাহসী রাজনীতিক নেতা ছিলেন। স্পষ্ট কথা বলতেন। বয়সে ছোট হলেও রাজনৈতিক কর্মীদের স্নেহ করতে বা উৎসাহ দিতে কখনো ভুল করতেন না। সদা হাস্যউজ্জল প্রধান ভাই সকল সময়ই বলতেন কমরেড চালিয়ে যাও। এই কমরেড শব্ধটি উচ্চারনের মধ্য দিয়ে তার যে ভালোবাসার বহি:প্রকাশ ঘটতো তা বলার ভাষা নাই। কখনো কোন রাজনৈতিক কর্মী কোন অনুষ্ঠানে দাওয়াত দিলে অনুষ্ঠানটি কতটা বড় কিংবা কতটা ছোট হবে তা নিয়ে ভাবতেন না। ভাবতেন একজন রাজনৈতিক কর্মীর আয়োজন যত ক্ষুদ্রই হোক সমাজে তার প্রভাব পড়বেই। একজন রাজনৈতিক নেতা হিসাবে তার পাশে থাকা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। আজকাল যখন জাতীয়তাবাদী নেতারা শিতাতপ নিয়ন্ত্রিত হল বা মিলনায়তন ছাড়া কর্মসূচী পালন করতে পাড়েন না, সেখানে শফিউল আলম প্রধান অবশ্যই ব্যাতিক্রম ছিলেন।
প্রধান ভাইয়ের ইন্তেকালের পর প্রথমে তার বাসভনের সামনে জানাযা তারপর দিনাজপুর, পঞ্চগড় জানাযা শেষে লাশ নিয়ে আশা হলো ঢাকায়। বায়তুল মোকাররম জাতিয় মসজিদে শেষ জানাযা অনুষ্ঠিত হলো সন্ধ্যার পর বনানী কবরস্থানে তার পিতার কবরেই তাকে শেষ বিছানায় শুয়িয়ে দেয়া হলো। সে দিনও আমরা তথাকথিত জাতীয়তাবাদীরা শফিউল আলম প্রধানকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করতে পারি নাই। যে বিএনপির নেতৃত্বে ১৮ দলীয় জোট গঠন ও পরবর্তীতে ২০ দলীয় জোট গঠন, জোটের আন্দোলনে প্রথম কাতারে থেকে নিয়ে আন্দোলন করেছেন সেই জোটের প্রধান নেতৃত্ব তার কফিনে একটি পুষ্পমাল্য অর্পনের মত উদরারতা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছিল। সিনিয়র নেতারা যত তারা তারি সম্ভব জানাযা শেষ করে চলে গেছেন। সেই দিন তার লাশটা কবরে পৌছে দিতে সর্বশেষ পর্যন্ত যারা ছিলেন তারা হলেন বাংলাদেশ ন্যাপ চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গানি, এনডিপি চেয়ারম্যান খোন্দকার গোলাম মোর্ত্তজা ও মহাসচিব মো. মঞ্জুর হোসেন ঈসা, এনপিপি চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, মহাসচিব মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফা, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ-বিএমএল সভাপতি এএইচএম কামরুজ্জামান খান, মহাসচিব এডভোকেট শেখ জুলফিকার বুলবুল চৌধুরী, বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান এডভোকেট সৈয়দ এহসানুল হুদা, বিনেপির কেন্দ্রীয় নেতা ও স্বাধীনতা ফোরাম সভাপতি আবু নাসের মুহম্মদ রহমাতুল্লাহ, আমি সহ অনেক সহযোদ্ধা। যারা তার শেষ জীবনের তরুন সহকর্মী। জাতীয়ভাবে পরিচিত নেতারা পারেন নাই প্রধান ভাইকে যথাযথ সম্মান প্রদনের মাধ্যমে শেষ বিদায় জানাতে।
যাই হোক জাতীয়তাবাদী এই সকল নেতাদের যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করতে পারি নাই বলেই হয়তো আজ জাতীয়তাবাদী শক্তির এই দু:সময়। শফিউল আলম প্রধানের ভাষায়, “তুমি তোমার সহকর্মীকে সম্মান করতে না পারলে, তার পাওনা বুঝিয়ে দিতে ব্যার্থ হলে তোমাকে তোমার নিয়তি বিচারের কাঠগড়ায় নিয়ে যাবে।” আজ হয়তো তাই চলছে।
আজ যখন শফিউল আলম প্রধানের ৮ম মৃত্যুবার্ষিকী তখন জুলাই বিপ্লবের সফলতার মধ্য দিয়ে ফ্যাসীবাদী শক্তি বিদায় হয়েছে। দেশে একটি গণতান্ত্রিক আবহ চলছে। আবার নতুন নতুন আশংকাও তৈরী হচ্ছে। আরাকানকে মানবিক কড়িডোর প্রধান, চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশীদের হাতে তুলে দেয়াসহ নানা প্রশ্নবিদ্ধ আলোচনা শুরু হয়েছে। এই সময়টা প্রধান ভাইকে বড্ড বেশী মনে পড়ছে। দেশের বর্তমান গভীর সংকটে শফিউল আলম প্রধানের খুবই প্রয়োজন ছিলো। তিনি দেশ ও জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কোন অপশক্তির কাছে মাথা নত করেননি। বরং শফিউল আলম প্রধান বিভিন্ন সরকারের আমলে এমপি-মন্ত্রীর প্রস্তাব পেয়েও তা প্রত্যাখান করেছেন। তিনি কখনো পরিবার ও নিজের জন্য রাজনীতি করেননি। শফিউল আলম প্রধান আজীবন দেশের মানুষের জন্য সংগ্রাম করে গেছেন।
রাজনৈতিক ভিন্ন মত থাকলেও একজন দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী নেতা শফিউল আলম প্রধানের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাতে পারছি আমার দলের নেতৃত্বের উদারতার কারণে। এখানেই মনে হয় রাজনীতির সৌন্দর্যতা। সমস্ত ব্যর্থতা, স্বার্থপরতার পরও বলতে চাই প্রধান ভাই শান্তি থাকুন। আপনার স্বপ্নের জাতীয়তাবাদী শক্তি আজ মুক্ত। জাতি প্রত্যাশা করে কালো মেঘ কেটে গেছে হয়তো দ্রুতই আলোর দেখা মিলবে। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, অখন্ডতা ও গণতন্ত্রের প্রশ্নে আপনার স্বপ্নের শক্তি জেগে থাকবে সকল সময়। শফিউল আলম প্রধান সারাজীবন আধিপত্যবাদ ও গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোলনে রাজপথে লড়াই করেছেন। তিনি গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোলনে কোনদিন আপোস করেন নাই। জীবনে ২৭ বছর কারাবরণ করতে হয়েছে তাকে। আজকের এই দুর্দিনে তাঁর মত নেতার বড়ই প্রয়োজন ছিল।
পরিশেষে শফিউল আলম প্রধানের অমর স্মৃতির প্রতি গভীরতম শ্রদ্ধা নিবেদন করছি ও তার রুহের মাগফেরাত কামনা করছি।