নিজস্ব প্রতিনিধিঃ শিক্ষাক্ষেত্রে বিরাজমান সরকারি-বেসরকারি বৈষম্য দূরীকরণের লক্ষ্যে মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণ, সারাদেশে শিক্ষক লাঞ্ছিত ও জোরপূর্বক পদত্যাগ করানোর তীব্র প্রতিবাদে এবং পদত্যাগ পত্র বাতিলপূর্বক স্বপদেপুনর্বহালের আদেশ সম্বলিত প্রজ্ঞাপন জারির দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেছে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি (বিটিএ)।
০৭ সেপ্টেম্বর-২০২৪ শনিবার সকাল ১১টায়“জাতীয় প্রেস ক্লাব”-এর “মাওলানা আকরাম খাঁ হল” এশিক্ষাক্ষেত্রে বিরাজমান সরকারি-বেসরকারি বৈষম্য দূরীকরণের লক্ষ্যে মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণ, সারাদেশে শিক্ষকদের লাঞ্ছিত ও জোরপূর্বক পদত্যাগ করানোর তীব্র প্রতিবাদে এবং পদত্যাগ পত্র বাতিলপূর্বক স্বপদে পুনর্বহালের আদেশ সম্বলিত প্রজ্ঞাপন জারির দাবিতে সমিতির সভাপতি অধ্যক্ষ মোঃ বজলুর রহমান মিয়া’র সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদকঅধ্যক্ষশেখ কাওছার আহমেদ -এর সঞ্চালনায় ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত দেশের সর্বপ্রাচীন ও সর্ববৃহৎ শিক্ষক সংগঠন বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি (বিটিএ)’র “সংবাদ সম্মেলন” অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য ও বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির অন্যতম উপদেষ্টা বাবু রঞ্জিত কুমার সাহা, দাসগুপ্ত আশি,সিনিয়র সহ সভাপতি অধ্যক্ষ মোঃ আবুল কাশেম, সহ সভাপতি আলী আসগর হাওলাদার, বেগম নূরুন্নাহার, মোঃ মহিউদ্দিন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবু জামিল মোঃ সেলিম, সাংগঠনিক সম্পাদক মোঃ ইকবাল হোসেন, দপ্তর সম্পাদক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন, সহ সাংগঠনিক সম্পাদক মোঃ হারুন-অর-রশিদ, বাহারুল ইসলাম, সহ মহিলা বিষয়ক সম্পাদক শাহানা বেগম, কেন্দ্রীয় সদস্য প্রবীর রঞ্জন দাস, আজম আলী খান, নাসরীন নাহার, মোঃ সাচুল হক, মোঃ আলমগীর হোসেন খান, মোঃ আফতাব উদ্দিন, ইসরাত জাহান আলো, ওবায়দুর রহমানসহ প্রমুখ শিক্ষক নেতৃবৃন্দ।
বক্তব্যের শুরুতে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি (ইঞঅ)’র পক্ষ থেকেবৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যাঁরা শহিদ হয়েছেন তাঁদের সকলে আত্মার মাগফিরাত কামনা এবং যাঁরা আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন আছেন, তাঁদের দ্রুত সুস্থতার জন্য সর্বশক্তিমান আল্লাহর নিকট দোয়া করা হয়।সংগঠনের সভাপতি অধ্যক্ষ মোঃ বজলুর রহমান মিয়া লিখিত বক্তব্যে বলেন,শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি বৈষম্য এখন পাহাড়সম। এহেন বৈষম্য দূরীকরণের জন্যসমিতির ব্যানারে শিক্ষক-কর্মচারীগণ দীর্ঘদিন যাবৎ আন্দোলন-সংগ্রাম করে আসছেন। বেসরকারি শিক্ষকগণ মাত্র ২৫% উৎসব ভাতা, ১,০০০ টাকা বাড়ি ভাড়া ও ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা পেয়ে থাকেন। অবসরে যাবার পর অবসর সুবিধা ও কল্যাণ ট্রাস্টের টাকা পেতে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হয়। ফলে অনেক শিক্ষক/কর্মচারী টাকা প্রাপ্তির পূর্বেই অর্থাভাবে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করেন যা অত্যন্ত দুঃখজনক। তাছাড়া কয়েক বছর যাবৎ কোন প্রকার বাড়তি সুবিধা না দিয়েই অবসর সুবিধা ও কল্যাণ ট্রাস্ট খাতে শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন থেকে অমানবিকভাবে অতিরিক্ত ৪% কর্তন করা হচ্ছে।পূর্বে সরকারি ও বেসরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক -এর বেতন স্কেল একই থাকলেও বর্তমানে বেসরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক সরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষকের চেয়ে এক ধাপ নিচে পেয়ে থাকেন। সরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক ৬ষ্ঠ গ্রেডে ৩৫,৫০০/- টাকা ও বেসরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক ৭ম গ্রেডে ২৯,০০০/- টাকা এবং এন্ট্রি লেভেলে সরকারি স্কুলের সহকারী শিক্ষক ১০ম গ্রেডে ১৬,০০০/- ও বেসরকারি স্কুলের সহকারী শিক্ষক ১১তম গ্রেডে ১২,৫০০/- টাকা পেয়ে থাকেন। তাছাড়া সহকারী প্রধান শিক্ষকদের উচ্চতর স্কেল প্রদানের বিধান না থাকায় উচ্চতর স্কেলপ্রাপ্ত সিনিয়র শিক্ষকদের বেতন স্কেল ও সহকারী প্রধান শিক্ষকদের বেতন স্কেল সমান হওয়ায় সহকারী প্রধান শিক্ষকদের মধ্যে দীর্ঘদিনের অসন্তোষ রয়েছে। নানা কারণে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখনও এমপিওভূক্ত হতে পারেনি। এমপিওভূক্ত বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের বদলীর কোন সুযোগ না থাকায় অনেকেই দূর-দূরান্তে শিক্ষকতা করার কারণে তাঁদের বৃদ্ধ বাবা-মাসহ পরিবার-পরিজন মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চাকরির বয়স ৬৫ করা হলেও স্কুল-কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকরির বয়সসীমা এখনও ৬০ বছরই রয়েছে। শিক্ষাপ্রশাসনের কোন স্তরেই এমপিওভূক্ত শিক্ষকদের পদায়নের কোন সুযোগ রাখা হয়নি। জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ এ শিক্ষক নিয়োগ কমিশন গঠনের কথা বলা হলেও এখনও তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। বহু আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ এখনও অনেকাংশেই অবাস্তবায়িত রয়েছে।
উপস্থিত নেতৃবৃন্দ বলেন, শিক্ষা ব্যবস্থায় সরকারি ও বেসরকারি বৈষম্য দূরীকরণের লক্ষ্যে মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণ এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। সকলের জন্য মানসম্মত শিক্ষার সমান সুযোগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শিক্ষক-কর্মচারীগণ দীর্ঘদিন যাবৎ মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণের দাবি জানিয়ে আসছেন। সর্বশেষ ২০২৩ সালে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি (ইঞঅ)’র ব্যানারে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে ১১ জুলাই থেকে ০১ আগস্ট-২০২৩ পর্যন্ত ২২ দিন লাগাতার অবস্থান ও পরিশেষে কাফনের কাপড় পরে আমরণ অণশন কর্মসূচি পালন করেছেন। যে কর্মসূচিতে পুলিশের লাঠিচার্জসহ অতি বাড়াবাড়ির কারণে বিটিএ’র কেন্দ্রীয় সভাপতি অধ্যক্ষ মোঃ বজলুর রহমান মিয়াসহ অনেক শিক্ষক-কর্মচারী আহত হন এবং ১ জন শিক্ষক মৃত্যুবরণ করেন। এমনকি আন্দোলনে নেতৃত্বদানের কারণে তৎকালীন শিক্ষা মন্ত্রী ডা. দীপু মনির রোষানলে পড়ে তাঁর নির্দেশে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি (ইঞঅ)’র সাধারণ সম্পাদকঅধ্যক্ষ শেখ কাওছার আহমেদ কে ষঢ়যন্ত্র করে সম্পূর্ণ বিধিবহির্ভূতভাবে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেন। যা মহামান্য হাইকোর্ট কর্তৃক স্থগিত করা স্বত্বেও তাঁকে যোগদান করতে দেয়া হয়নি। ডা. দীপু মনির নজিরবিহীন স্বেচ্ছাচারিত ও বিরোধিতা স্বত্বেও অবিরাম কর্মসূচি চলাকালীন গত ০১ আগস্ট ২০২৩ তৎকালীন সরকারের সাথে দীর্ঘ আলোচনার পর উত্থাপিত দাবিসমূহ যৌক্তিক বলে বিবেচিত হওয়ায় সরকারি-বেসরকারি বৈষম্য দূরীকরণের লক্ষ্যে মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। বিশেষ করে আর্থিক প্রাপ্তির ক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা, বাড়ী ভাড়া ও চিকিসা ভাতাসহ বিদ্যমান সরকারি ও বেসরকারি বৈষম্যসমূহ দ্রুততম সময়ের মধ্যে দূরীকরণের প্রতিশ্রুতি দেয়ায় আন্দোলন মূলতবী করা হয়েছিল। পরিতাপের বিষয় বিগত সরকার প্রতিশ্রতি দিয়েও তা রক্ষা করেননি।
তাই সকলের জন্য মানসম্মত শিক্ষা গ্রহণের সমান সুযোগ সৃষ্টি, মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্টকরণ এবং শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি বৈষম্য দূরিকরণের লক্ষ্যে ১১ দফা দাবি পেশ করেন:Ñ(১) মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্টকরণসহ শিক্ষাক্ষেত্রে সকারি ও বেসরকারি বৈষম্য দূরিকরণের লক্ষ্যে “মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণ” করা। (২) বিদ্যমান শিক্ষা কারিকুলামের পরিবর্তে যুগোপযোগী, আধুনিক ও বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষা কারিকুলাম প্রবর্তন করা। (৩) সরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের ন্যায় পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা, বাড়ী ভাড়া ও চিকিসা ভাতা প্রদান করা।(৪)সরকারি স্কুলের ন্যায় বেসরকারি স্কুলের ‘প্রধান শিক্ষক’ -এর বেতন স্কেল ৬ষ্ঠ গ্রেডে ও সহকারী শিক্ষক -এর ১০ম গ্রেডে এবং সহকারী প্রধান শিক্ষক -এর উচ্চতর স্কেল প্রদান করা। (৫) এমপিওভূক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বদলী প্রথা চালু করা।(৬)সরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের ন্যায় পেনশন প্রথা চালুকরণ এবং চালু না হওয়া পর্যন্ত অবসর গ্রহণের ৬ মাসের মধ্যে অবসর সুবিধা ও কল্যাণ ট্রাস্টের পাওনা প্রদানসহ শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন থেকে অতিরিক্ত ৪% কর্তন বন্ধ করা। (৭) শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকরির বয়স বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীদের ন্যায় ৬৫ বছরে উন্নীতকরণ।(৮) পাবলিক সার্ভিস কমিশনের ন্যায় শিক্ষক নিয়োগ কমিশন গঠন এবং শিক্ষা প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে আনুপাতিক হারে এমপিওভূক্ত শিক্ষকদের পদায়ন করা।(৯) শিক্ষাক্ষেত্রে বিরাজমান সরকারি ও বেসরকারি সকল বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ এর দ্রুত বাস্তবায়ন করা।(১০)ম্যানেজিং কমিটি/গভর্নিং বডি প্রথা বিলুপ্ত করে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ন্যায় পরিচালনা করা।(১১) স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভূক্ত করা।
লিখিত বক্তব্যে,সাম্প্রতিক সারাদেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একটি মহল ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করে প্রতিষ্ঠানে কর্মরত অধ্যক্ষ/প্রধান শিক্ষকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষকদের লাঞ্ছিত ও সম্পূর্ণ অবৈধভাবে জোরপূর্বক পদত্যাগ করতে বাধ্য করছে। শিক্ষক-কর্মচারীগণ বিশ্বাস করেন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোন নেতা-কর্মী, যাঁদের সাহসী ও ত্যাগের বিনিময়ে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বিগত সরকারের পতন হয়েছে তাঁদের কেউই শিক্ষক লাঞ্ছনার মত অপকর্মে লিপ্ত হতে পারেন না। বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি (বিটিএ)’র পক্ষ থেকে -এর তীব্র প্রতিবাদ এবং উক্তপদত্যাগ পত্র বাতিলপূর্বক স্বপদে পুনর্বহালের আদেশ সম্বলিত প্রজ্ঞাপন জারির জন্য বর্তমান সরকারের নিকট জোর দাবিজানান এবং আগামী ১৪ সেপ্টম্বর ২০২৪ শনিবার শিক্ষাক্ষেত্রে বিরাজমান সরকারি-বেসরকারি বৈষম্য দূরীকরণের লক্ষ্যে মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণ, সারাদেশে শিক্ষক লাঞ্ছিত ও জোরপূর্বক পদত্যাগ করানোর তীব্র প্রতিবাদে এবং পদত্যাগ পত্র বাতিলপূর্বক স্বপদে পুনর্বহালের আদেশ সম্বলিত প্রজ্ঞাপন জারির দাবিতে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি (ইঞঅ)’র উদ্যোগে সারাদেশের জেলা সদরে মানববন্ধন কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। পরিশেষে, দেশ ও জনগণের অগ্রগতি, উন্নয়ন ও কল্যাণের লক্ষ্যে সরকারের প্রতিটি শুভ পদক্ষেপের সাফল্য কামনা করেন।