নিজস্ব প্রতিনিধিঃ আজ ২৬ জুন ২০২৪ বুধবার বিকাল ৪:০০ টায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে (শহীদ ক্যাপ্টেন মনসুর আলী সরণি, ১/ক,সেগুনবাগিচা,ঢাকা) বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, নারীমুক্তি, মানবমুক্তি এবং গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব ও জননী সাহসিকা কবি সুফিয়া কামালের ১১৩তম জন্মবার্ষিকীতে সুফিয়া কামাল স্মারকবক্তৃতা, সুফিয়া কামাল সম্মাননা প্রদান ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম।
যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেমের সঞ্চালনায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু। ‘নারীর প্রতি প্রচলিত গৎবাঁধা দৃষ্টিভঙ্গী ঃ সুফিয়া কামালের আন্দোলন’ বিষয়ে স্মারকবক্তৃতা প্রদান করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ড. আইনুন নাহার। সুফিয়া কামাল সম্মাননা প্রদান করা হয় প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এবং প্রয়াত স্থপতি কবি রবিউল হুসাইনকে। প্রদানকৃত সম্মাননা গ্রহণ করেন প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহের কন্যা সাইকা মাহমুদ এবং প্রয়াত স্থপতি কবি রবিউল হুসাইনের পুত্র জিসান হুসাইন। সম্মাননা প্রাপ্ত ব্যক্তিদের পরিচিতি পাঠ করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রকাশনা সম্পাদক সারাবান তহুরা এবং প্রশিক্ষণ গবেষণা ও পাঠাগার সম্পাদক রীনা আহমেদ।
সভাপতির বক্তব্যে ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন,সুফিয়া কামাল আজীবন নারী পুরুষের সমতা, সাম্য ও সমাজের শান্তির জন্য লড়াই করেছেন। গৎবাধা লিঙ্গীয় নির্মাণ কিভাবে হয়, সমাজ জীবন কে পরিচালিত করে, কর্মকান্ডকে প্রভাবিত করতে কে নিয়ন্ত্রণ করে, সমাজ ভেদে এসকল বিষয়ে পার্থক্য থাকলেও মোটা দাগে সমাজে নারীকে অধঃস্তন হিসেবে ই ভাবা হয়। এসকল কুপ্রথার মধ্য থেকে তিনি নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রথা ভেঙে এগিয়েছেন, প্রতিবাদ করেছেন এবং পথ নির্মাণ করেছেন। নারী আন্দোলন সামাজিক আন্দোলনের অংশ, এটি কেবল নারীর জন্য নয়; দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন, গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং আইন প্রতিষ্ঠা ও সুশাসনের আন্দোলন নারী আন্দোলনের সাথে একই সূত্রে গাথা।
স্বাগত বক্তব্যে সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, সুফিয়া কামাল আমাদের জন্য প্রাত:সম্মরণীয় হলেও তাঁর যে বিশাল কর্মময় জীবন তার অংশবিশেষ নতুন প্রজন্মের নিকট তুলে ধরার লক্ষ্যে প্রতিবছর তাকে স্মরণ করে স্মারকবক্তৃতা ও সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। তিনি ছিলেন এক অতুলনীয় মানবিক গুণাবলির অধিকারী, যার ভেতরে থাকা আত্মশক্তিকে কোন শাসকগোষ্ঠী কখনোই উপেক্ষা করতে পারেননি। তিনি আরো বলেন পিতৃতান্ত্রিক এই সমাজে নারী লেখক হিসেবে, কবি হিসেবে উপেক্ষিত, এমন এক সমাজে সুফিয়া কামাল কবি হিসেবে লেখক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, স্বীকৃতি আদায় করেছেন এবং নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। নারীর প্রতি প্রচলিত বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি কে চ্যালেঞ্জ করে সামনে অগ্রসর হতে বর্তমান প্রজন্মকে সুফিয়া কামালের পদাঙ্ক অনুসরণ করে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
স্মারকবক্তৃতায় ড. আইনুন নাহার বলেন, গৎবাঁধা লিঙ্গীয় নির্মাণ স্থান ও কাল নির্বিশেষে সকল সমাজেই শক্তিশালীভাবেই এটি দেখা যায় যদিও সংস্কৃতিভেদে এর ভিন্নতা রয়েছে। যখন গৎবাঁধা লিঙ্গীয় নির্মাণ এর ভিত্তিতে নারীর প্রতি বৈষম্য নিয়ে কথা বলা হয় কিংবা নারীর অধিকার নিয়ে কথা হয় তখন সুস্পষ্টভাবে মনে রাখা প্রয়োজন যে, সকল নারীর জীবন এবং অভিজ্ঞতা একই নয়। এই গৎবাঁধা ভাবনাগুলো বিভিন্ন সময়ে চ্যালেঞ্জড হয়, পরিবর্তিতও হয়। সুফিয়া কামাল শৈশবকাল থেকেই তার জীবনব্যাপী নারীকে যে গৎবাধা ছকে ফেলে দেখা হয় তার সীমানা ভেঙ্গেছেন, প্রশ্ন করেছেন সামাজিক রীতিনীতিকে এবং সহনশীল ও অটল মনোভাব থেকেই বাস্তবতার নিরিখে নারীর অধিকার ও সামাজিক ন্যায় বিচারের জন্য লড়াই করেছেন। তিনি খুব অল্প বয়স থেকেই ঘর-সংসার সামলে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক-সামাজিক আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িত থেকে পুরুষের আধিপত্যশীল পারিবারিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক পরিসরে গৎবাঁধা লিঙ্গীয় মতাদর্শ ও চর্চাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। লিঙ্গীয় অসমতার বিরুদ্ধে তাঁর নানামুখী নিরলস কার্যক্রম বাংলাদেশের নারী সমাজকে নিরন্তর লড়াই করতে অনুপ্রাণিত যুগিয়েছে। সর্বোপরি সুফিয়া কামালকে নিয়ে অনেক লেখালেখি আছে ঠিকই কিন্তু সেগুলো মোটাদাগে সীমিত বা খন্ডিত পরিসরেই রয়ে গেছে। তাঁর বহু মাত্রিক সত্ত্বা ও সম্পৃক্ততা, তাঁর লেখনী, নারী আন্দোলনের পাশাপাশি অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং ন্যায়সঙ্গত সমাজ প্রতিষ্ঠার লড়াই নিয়ে আরো গভীরভাবে অনুসন্ধান ও গবেষণা করা আজ সময়ের দাবি। এই কাজ কেবল চলমান নারী আন্দোলনকেই নয় বরং নতুন প্রজন্মকেই অনুপ্রাণিত করবে এবং একই সঙ্গে বৃহত্তর পরিসরকেও প্রভাবিত করবে বলে তিনি স্মারকবক্তৃতায় উল্লেখ করেন।
অনুষ্ঠানের শুরুতে কবি সুফিয়া কামালের প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের নেত্রীবৃন্দ, এসময় কবি সুফিয়া কামাল কে নিয়ে তৈরি করা প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। সংগীত পরিবেশন করেন বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ইফ্ফাত আরা দেওয়ান এবং বিশিষ্ট নজরুল সংগীত শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। আবৃত্তি করেন বাংলা শুদ্ধ উচ্চারণ গবেষক ও আবৃত্তিকার গোলাম সারোয়ার।
উক্ত সুফিয়া কামাল স্মারকবক্তৃতা, সুফিয়া কামাল সম্মাননা প্রদান ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় ও ঢাকা মহানগর কমিটির নেতৃবৃন্দ, সম্পাদকমন্ডলী, কর্মকর্তারা এবং প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।