নিজস্ব প্রতিনিধিঃ খাগড়াছড়ির পানছড়িতে নারী নেত্রী কল্পনা চাকমার চিহ্নিত অপহরণকারী লে. ফেরদৌস, সালেহ আহম্মেদ ও নুরুল হককে জনতার আদালতে প্রতীকী বিচার ও ফাঁসি দেওয়া দেওয়া হয়েছে।
আজ শনিবার (৮ জুন ২০২৪) সকালে পানছড়ির লোগাং বাবুড়াপাড়া এলাকায় পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘ, গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম ও পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এক প্রতিবাদ সমাবেশের মাধ্যমে উক্ত বিচার ও ফাঁসি কার্যকর করা হয়।সকাল সাড়ে ১০টায় লোগাং করল্যাছড়ি উচ্চবিদ্যালয় গেট থেকে একটি বিশাল বিক্ষোভ মিছিল শুরু করা হয়। মিছিলটি বাবুড়াপাড়া বাজার ঘুরে এসে সীমান্ত সড়কের প্রবেশমুখে মিলিত হয়ে প্রথমে সমাবেশ ও পরে বিচারকার্য চালায়। এতে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীসহ সহস্রাধিক নারী-পুরুষ অংশগ্রহণ করেন।
সমাবেশে পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘের সদস্য মানিকপুদি চাকমার সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন ইউপিডিএফ সংগঠক বকুল চাকমা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক বরুন চাকমা, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ পানছড়ি উপজেলা শাখার সভাপতি সুনীল ময় চাকমা ও গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের পানছড়ি উপজেলা সভাপতি রিপন ত্রিপুরা।
ইউপিডিএফ নেতা বকুল চাকমা তার বক্তব্যে বলেন, সরকার-শাসকশ্রেণী পাহাড়িদের ধ্বংস করে দেয়ার জন্য বিভিন্নভাবে ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বললে সরকার ভয় পায় এবং ভালো চোখে দেখে না। কল্পনা চাকমাও অন্যায় নিপীড়নের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। যার কারণে লেফটেনেন্ট ফেরদৌস কর্তৃক তাকে অপহরণ করা হয়। এই অপহরণের ২৮ বছরেও সরকার কল্পনা চাকমার সন্ধান দিতে পারেনি। চিহ্নিত অপহরণকারীদের গ্রেফতার ও বিচার করেনি। তাই আজ জনতার আদালতে অপহরণকারীদের প্রতীকী বিচার হচ্ছে।
যুব নেতা বরুন চাকমা বলেন, কল্পনা চাকমা অপহরণের ২৮ বছরেও আমরা তার সন্ধান পাইনি, সরকার তার সন্ধান দিতে পারেনি। যারা কল্পনা চাকমাকে অপহরণ করেছে সেই চিহ্নিত লে. ফেরদৌস গংদের গ্রেফতার করা তো দুরের কথা, বরং বার বার তাদেরকে বিভিন্নভাবে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছে।
তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের পক্ষপাতদুষ্ট আদালত মামলার শুনানির নামে বার বার কালক্ষেপন করেছে। সর্বশেষ গত ২৩ এপ্রিল পক্ষপাতদুষ্ট আদালতের মাধ্যমে মামলা খারিজ করে দিয়ে চিহ্নিত অপহরণকারীদের দায়মুক্তি দিয়েছে। আমরা আদালতের এই রায় মানিনা এবং প্রত্যাখ্যান করছি। জনতার আদালতের মধ্যমে আজকে আমরা কল্পনা অপহরণকারীদের প্রতীকী ফাঁসি প্রদান করবো।
তিনি বলেন, শুধু কল্পনা চাকমা’র অপহরণকারীদের নয়, পার্বত্য চট্টগ্রামে যে ডজনের অধিক গণহত্যা সংঘটিত করা হয়েছে সে সকল গণহত্যায় বাংলাদেশ সেনাবিহিনী ও সেনাপ্রশাসন প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জড়িত। সেই গণহত্যায় জড়িতদের এই রাষ্ট্র বিচার করেনি। পার্বত্য চট্টগ্রামের জনতার আদালত তাদেরও বিচার করবে।
তিনি পাহাড়ে অরাজকতার জন্য দায়ী সেনাবাহিনীকে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে প্রত্যাহারের দাবি জানান।
পিসিপি নেতা সুনীল ময় চাকমা বলেন, পাহাড়ে আজ কেউ নিরাপদ নয়। আমরা সেনাবাহিনী কর্তৃক বিভিন্নভাবে নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হচ্ছি। শুধু কল্পনা চাকমা অপহরণ নয়, বন্দরবানেও বম জনগোষ্ঠীদের ওপর সেনাবাহিনী দমন পীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে। ৫ম শ্রেণীর ছাত্রদের পর্যন্ত গুলি করে হত্যা করছে। দীর্ঘ ২৮ বছরেও এই রাষ্ট্রের কাছে আমরা কল্পনা চাকমা অপহরণের সুষ্ঠু বিচার পাইনি।
সমাবেশে রিপন চকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী অন্যায়-অবিচার করলেও কোন বিচার হয় না। ২০১৮ সালে রাঙ্গামাটির বিলাইছড়িতে সেনা সদস্য কর্তৃক দুই মারমা কিশোরী বোনকে ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের ঘটনার কোন বিচার হয়নি। তিনি কল্পনা চাকমার চিহ্নিত অপহরণকারীদের গ্রেফতার করে শাস্তি দেয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
সমাবেশের বক্তব্য শেষে প্রতীকী জনতার আদালতের কার্যক্রম শুরু হয়। আদালতের বিচারক হিসেবে বিচারকার্য পরিচালন করেন অনিল চন্দ্র চাকমা। এ সময় আইনজীবীর ভূমিকা পালন করেন বকুল চাকমা ও মামলার বাদী ও ঘটনার সাক্ষী হিসেবে কালিন্দী কুমার চাকমার ভূমিকা পালন করেন পিংকু চাকমা। বিচার চলাকালে জনতা কল্পনা অপহরণকারীদেরদ ফাঁসি চাই, ফাঁসি চাই বলে তুমুল শ্লোগান দেন।
এ সময় বিচারক সাক্ষীর জবানবন্দি শোনার পর অপহরণ ঘটনা পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে কল্পনা চাকমার অপহরণকারী হিসেবে লে. ফেরদৌস, ভিডিপি প্লাটুন কমাণ্ডার সালেহ আহমেদ ও ভিডিপি সদস্য নুরুল হককে দোষী সাব্যস্ত করেন এবং তাদের সকলকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ ঘোষণা করে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আদেশ জারি করেন। এ সময় উপস্থিত সকলে হাততালি দিয়ে রায়ের প্রতি সমর্থন জানান।
জনতার আদালতের রায়ে লে. ফেরদৌস, ভিডিপির প্লাটুন কমান্ডার সালেহ আহমদ ও সদস্য নুরুল হক যে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেত্রী কল্পনা চাকমাকে জোরপূর্বক অপহরণ করেছে তা সুস্পষ্টভাবে ও সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।
আদালতের রায় ঘোষণার পরপরই পাহাড়িদের রীতি অনুযায়ী মানুষের মৃত্যুর পর যেভাবে ঢোল বাঁজানো হয় প্রতীকী হিসেবে সেভাবে ঢোল বাজিয়ে জনতা কল্পনা চাকমার চিহ্নিত অপহরণকারী লে. ফেরদৌস, সালেহ আহম্মেদ ও নুরুল হককে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেন।