রুপসীবাংলা৭১ অন্যান্য ডেস্ক : মানুষের মুখে উচ্চারিত একটি বাক্য কখনো হয় দোয়ার মতো নির্মল, আবার কখনো হয় বিষের মতো বিধ্বংসী। যুদ্ধক্ষেত্রে যে কাজ করতে শত শত অস্ত্র লাগে, অনেক সময় তা একটি গুজবই করে ফেলে। সমাজ ধ্বংসের জন্য সব সময় ট্যাংক কিংবা কামান প্রয়োজন হয় না; কখনো ফিসফিস করা একটি কথা, আড়ালে বলা একটি মন্তব্য কিংবা যাচাইহীন একটি অভিযোগই যথেষ্ট। ইসলাম এই বাস্তবতাকে গভীরভাবে অনুধাবন করেছে বলেই গিবত, অপবাদ ও গুজবের বিরুদ্ধে কঠোর সতর্কবার্তা উচ্চারণ করেছে।
অনুপস্থিত ভাইয়ের মর্যাদা ভক্ষণের পাপ
রাসুলুল্লাহ (সা.) গিবতের সংজ্ঞা দিয়ে বলেছেন, ‘তোমার ভাইয়ের এমন কোনো বিষয় উল্লেখ করা, যা সে অপছন্দ করে; তা-ই গিবত।’ সাহাবিরা জিজ্ঞেস করলে তিনি আরো ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘যদি সেই দোষ তার মধ্যে সত্যিই থাকে, তবে তা গিবত; আর যদি না থাকে, তবে তা অপবাদ।’ (মুসলিম, হাদিস : ২৫৮৯)
এই সংজ্ঞা থেকেই বোঝা যায়, গিবত কোনো অস্পষ্ট নৈতিক অপরাধ নয়, বরং একটি সুস্পষ্ট সীমা লঙ্ঘন। আশ্চর্যের বিষয় হলো অনেকেই সত্য বলার আত্মতুষ্টির আড়ালে গিবত করে যাচ্ছে।
নিজ স্বার্থ হাসিলের জন্য মুসলিম ভাইয়ের বদনাম করে বেড়াচ্ছে; আর বলছে যে আমি কি মিথ্যা বলেছি? সত্যই তো বলেছি। অথচ ইসলাম সত্য বলাকেও শর্তসাপেক্ষ করেছে; সত্য হতে হবে কল্যাণকর, ন্যায়ের পক্ষে এবং প্রয়োজনীয়।
পবিত্র কোরআনে গিবতের ভয়াবহ রূপক এমন ভাষায় তুলে ধরা হয়েছে, যা মানুষের বিবেককে নাড়িয়ে দেয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত ভক্ষণ করতে পছন্দ করবে? নিশ্চয়ই তোমরা তা ঘৃণা করো।
’ (সুরা : হুজুরাত, আয়াত : ১২)
এখানে গিবতকে শুধু হারাম বলা হয়নি, বরং মৃত ভাইয়ের গোশত ভক্ষণের মতো জঘন্য কাজের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। কারণ গিবতের শিকার ব্যক্তি অনুপস্থিত; সে আত্মপক্ষ সমর্থনও করতে পারে না।
নির্দোষকে অপরাধী বানানোর পাপ
গিবতের চেয়েও ভয়াবহ অপরাধ হলো অপবাদ। কাউকে এমন দোষ আরোপ করা, যা আদৌ তার মধ্যে নেই। পবিত্র কোরআনের ভাষায় একে বলা হয়েছে ‘বুহতান’, যা মানুষকে স্তম্ভিত করে দেয় এমন মিথ্যা।
মহান আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যারা মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদের ওপর অপবাদ আরোপ করে, অথচ তারা তা করেনি; তারা তো এক গুরুতর মিথ্যা ও প্রকাশ্য গুনাহ বহন করল।’ (সুরা : আহজাব, আয়াত : ৫৮)
ইসলামের ইতিহাসে ‘ইফকের ঘটনা’ অপবাদের ভয়াবহতার এক জীবন্ত দলিল। আয়েশা (রা.)-এর বিরুদ্ধে ছড়ানো মিথ্যা রটনা শুধু একজন ব্যক্তিকে নয়, পুরো মদিনার সমাজকে অস্থির করে তুলেছিল। পরে আল্লাহ নিজেই পবিত্র কোরআনের আয়াত নাজিল করে তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা করেন। (সুরা : নূর, আয়াত : ১১-২৬)
এই ঘটনা প্রমাণ করে, অপবাদ শুধু ব্যক্তিগত পাপ নয়; এটি সামাজিক স্থিতি নষ্ট করার এক ভয়ংকর হাতিয়ার।
যাচাইহীন তথ্যের সামাজিক বিস্ফোরণ
গুজব হলো এমন তথ্য, যার সত্যতা যাচাই করা হয়নি; কিন্তু তা ছড়িয়ে পড়েছে দ্রুত, ব্যাপকভাবে এবং আবেগের সঙ্গে। আধুনিক যুগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুজবের গতি বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। একটি অসত্য সংবাদ মুহূর্তে হাজারো মানুষের বিশ্বাসে জায়গা করে নেয়।
পবিত্র কোরআন এ ব্যাপারে অত্যন্ত বাস্তববাদী নির্দেশনা দিয়েছে। মহান আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে ঈমানদাররা! যদি কোনো ফাসিক তোমাদের কাছে কোনো বার্তা নিয়ে আসে, তাহলে তোমরা তা পরীক্ষা করে দেখ, এ আশঙ্কায় যে অজ্ঞতাবশত তোমরা কোনো সম্প্রদায়কে আক্রমণ করে বসবে, ফলে তোমাদের কৃতকর্মের জন্য তোমাদের অনুতপ্ত হতে হবে।’ (সুরা : হুজুরাত, আয়াত : ৬)
এই আয়াত শুধু ব্যক্তিগত সতর্কতা নয়; এটি একটি পূর্ণাঙ্গ সামাজিক নীতি। যাচাইহীন সংবাদ ছড়ানো মানে অজান্তেই জুলুমের অংশীদার হয়ে যাওয়া।
এই আয়াত নাজিল হওয়ার পেছনে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাস্তব ঘটনা আছে, যা ইসলামে সংবাদ যাচাইয়ের অপরিহার্যতা স্পষ্ট করে। বনু মুস্তালিক গোত্রের নেতা হারেস ইবনে দ্বিরার (রা.) ইসলাম গ্রহণ করে জাকাত প্রদানের অঙ্গীকার করেন এবং নির্ধারিত সময়ে জাকাত সংগ্রহের জন্য দূত পাঠানোর অনুরোধ জানান। কিন্তু নির্ধারিত দিনে জাকাত গ্রহণের জন্য কোনো দূত না পৌঁছানোয় তিনি আশঙ্কা করেন যে হয়তো রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর গোত্রের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছেন।
অন্যদিকে রাসুলুল্লাহ (সা.) জাকাত সংগ্রহের জন্য ওলিদ ইবনে উকবা (রা.)-কে পাঠান। পথিমধ্যে পুরনো শত্রুতার আশঙ্কায় তিনি গোত্রে প্রবেশ না করেই ফিরে আসেন এবং ভুল ধারণার ভিত্তিতে জানান যে তারা জাকাত দিতে অস্বীকার করেছে এবং তাঁর ওপর আক্রমণের ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। এই সংবাদে রাসুলুল্লাহ (সা.) ক্ষুব্ধ হয়ে খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা.)-এর নেতৃত্বে একটি বাহিনী পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন।
পরে ঘটনা যাচাই হলে স্পষ্ট হয় যে বনু মুস্তালিক গোত্র জাকাত দিতে প্রস্তুত ছিল এবং ওলিদ (রা.) আদৌ তাদের কাছে যাননি। এই ভুল তথ্যের কারণে প্রায় এক ভয়াবহ সংঘাত সৃষ্টি হওয়ার উপক্রম হয়েছিল।
ঠিক এই প্রেক্ষাপটেই আল্লাহ তাআলা সুরা হুজুরাতের আয়াত নাজিল করে মুমিনদের নির্দেশ দেন—যাচাই ছাড়া কোনো সংবাদ গ্রহণ করা যাবে না, কারণ তাতে নির্দোষ মানুষের ক্ষতি হয়ে যেতে পারে এবং পরে অনুতপ্ত হতে হয়।
কেন এগুলো ‘নীরব অস্ত্র’?
গিবত, অপবাদ ও গুজবকে নীরব অস্ত্র বলা হয়, কারণ এগুলো প্রকাশ্য যুদ্ধের মতো শব্দ করে না; কিন্তু ভেতরে ভেতরে সমাজের মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়। বিশ্বাসের জায়গায় সন্দেহ জন্মায়, ভালো মানুষের মর্যাদা নষ্ট হয়, নেতৃত্ব দুর্বল হয়, আর শত্রুরা বিনা খরচে সুযোগ পেয়ে যায়।
রাসুলুল্লাহ (সা.) উম্মাহকে এই বিপদ থেকে রক্ষা করতে বলেন, ‘মুমিনরা পরস্পরের ভাই। সে তার ভাইয়ের ওপর জুলুম করে না, তাকে অপমান করে না।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৫৬৪)
যে সমাজে মানুষ একে অপরের সম্মান রক্ষা করে না, সে সমাজ দীর্ঘদিন টিকে থাকতে পারে না।
নীরবতা, যাচাই ও তাকওয়াই মুক্তির পথ
ইসলাম এসব কাজে শুধু নিষেধাজ্ঞাই দেয়নি; বরং বিকল্প পথও দেখিয়েছে। অপ্রয়োজনীয় কথা থেকে বিরত থাকা, সংবাদ যাচাই করা এবং অন্তরে আল্লাহভীতি জাগ্রত রাখা—এই তিনটি গুণই একজন মুমিনকে এসব পাপ থেকে রক্ষা করতে পারে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস করে, সে যেন ভালো কথা বলে অথবা নীরব থাকে।’ (বুখারি, হাদিস : ৬০১৮)
এই নীরবতা দুর্বলতা নয়, বরং এটি আত্মসংযমের এক বিরাট শক্তি। গিবত, অপবাদ ও গুজব—এগুলো বাহ্যিকভাবে ছোট মনে হলেও ভেতরে ভেতরে সমাজকে ফোকলা করে দেয়। এগুলো এমন আগুন, যা ঘর পুড়িয়ে দেয়, কিন্তু ধোঁয়া কম ওঠে। একজন সচেতন মুসলিমের দায়িত্ব হলো নিজের জিহ্বা সংযত রাখা, কলম ও কি-বোর্ডের আমানত রক্ষা করা এবং সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে অবিচল থাকা।
আল্লাহ আমাদের জিহ্বাকে পবিত্র রাখুন, হৃদয়কে পরিশুদ্ধ করুন এবং সমাজকে এই নীরব অস্ত্রের ক্ষতি থেকে হেফাজত করুন। আমিন।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক
রুপসীবাংলা৭১/এআর

