নিজস্ব প্রতিনিধি :মানুষের মৃত্যু এবং রোগাক্রান্ত হওয়ার বিবেচনায় তামাক একটি ভয়াবহ মহামারীর নাম। দেশে তামাকজনিত রোগে প্রতি বছর মৃতের সংখ্যা করোনা মহামারীতে ৩ বছরের মোট মৃতের সংখ্যার চেয়ে প্রায় ১৪ গুণ। তাই জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার স্বার্থে কার্যকর তামাক নিয়ন্ত্রণ অত্যাবশ্যক। আর এর জন্য প্রয়োজন একটি শক্তিশালী তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন। দুই দশক ধরে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতায় আইনটির কিছু দুর্বলতা চিহ্নিত হয়েছে এবং সময়ের সাথে কিছু নতুন চ্যলেঞ্জ সামনে এসেছে। তাই জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার স্বার্থে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটিকে পুনঃসংশোধনের মাধ্যমে আরও শক্তিশালী দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
আজ সোমবার (১ ডিসেম্বর ২০২৫) বিকেলে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এসব কথা বলেন দেশের খ্যাতনামা ১৩ জন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ।
বিবৃতিতে তারা বলেন, বাংলাদেশে প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যুর সবচেয়ে বড় কারণ তামাক। বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির গবেষণায় দেখা যায় দেশে প্রতি বছর প্রায় ১৫ লক্ষ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাকজনিত রোগে ভোগেন। টোব্যাকো এটলাসের তথ্য অনুসারে তামাকজনিত রোগে প্রতি বছর ১ লক্ষ ৬১ হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয় এবং প্রায় ৪ লক্ষ মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করে। পরোক্ষ ধূমপানের কারণে দেশে প্রতি বছর প্রায় ২৫ হাজার মানুষ মারা যায় এবং প্রায় ৬১ হাজার শিশু রোগাক্রান্ত হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী বিশ্বে প্রতিবছর ৮০ লক্ষেরও বেশি মানুষ তামাক ব্যবহারজনিত রোগে মারা যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটি এর সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২৪ সালে তামাক ব্যবহারের কারণে স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত ব্যয় ছিল ৮৬ হাজার কোটি টাকা যার মধ্যে ৬৫ হাজার কোটি টাকাই তামাকজনিত স্বাস্থ্য ব্যয়। একই সময়ে তামাক থেকে রাজস্ব আয় ছিলো ৪০ হাজার কোটি টাকা যা তামাক ব্যবহারের কারণে হওয়া অর্থনৈতিক ক্ষতির অর্ধেকেরও কম। দেশে তামাক ব্যবহারজনিত রোগের চিকিৎসা খরচ যোগাতে গিয়ে প্রতিবছর দেশের প্রায় ৪ লক্ষ মানুষ দরিদ্র হয়ে যাচ্ছে বলেও বিবৃতি জানিয়েছেন তারা।
আইন শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেওয়ায় সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বিবৃতিতে তারা বলেন, তামাক নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত আইন ও নীতি প্রণয়ন ও সরকারের অন্যান্য পদক্ষেপকে ব্যহত করতে তামাক কোম্পানিগুলো বিভ্রান্তকর ও মিথ্যা প্রচারণা চলাচ্ছে। তারা বলে, আইন শক্তিশালী হলে সরকারের রাজস্ব আয় কমে যাবে। কিন্তু তামাকজাত দ্রব্যের মূল্য ও কর ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধির ফলে গত ২০ বছরে এই খাত থেকে রাজস্ব আয় বেড়েছে ১৪ গুণ। এবং প্রতি বছর এই খাত থেকে সরকারের রাজস্ব আয় পূর্ববর্তী বছরের চেয়ে বেশি ছিলো। কিন্তু এই সময়ে, ২০০৯ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে দেশে তামাক ব্যবহার প্রায় ১৮% কমেছে এবং ২০০৫ সালে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন পাস এবং ২০১৩ সালে আইন আরো শক্তিশালী করা হয়েছে।
বিবৃতিতে তারা তামাক বিরোধী নীতি নির্ধারণে রাজস্ব আয়কে প্রাধান্য দেওয়ার সমালোচনাও করেন। তারা বলেন, আধুনিক রাষ্ট্র চিস্তায় রাজস্ব আয় কখনোই জনস্বাস্থ্য এবং মানুষের মৃত্যুর চেয়ে ‘বড়’ বিবেচ্য হতে পারে না।
বিবৃতিতে তারা আরও বলেন, তামাক কোম্পানি প্রাণঘাতী পণ্যের ব্যবসা করে মুনাফা অর্জনের জন্য। মানুষের মৃত্যু বা ক্ষতি তাদের বিবেচ্য নয়। মিথ্যাচারের মাধ্যমে তারা প্রকৃত সত্যকে আড়াল করছে। শিশু-কিশোরদের তামাকের নেশায় আকৃষ্ট করতে তারা বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে ধূমপানের স্থান তৈরি করে দিচ্ছে, মূল্য বৃদ্ধি ও খুচরা শলাকা বিক্রি বন্ধের উদ্যোগকে ব্যহত করছে, বিক্রয় স্থলে আগ্রাসী বিজ্ঞাপন দিচ্ছে, দেশে ভেপিং ও ই-সিগারেটের ব্যবহার বাড়াতে যুবকদের নিয়ে গোপনে ভেপিং মেলার আয়োজন করছে, আইন শক্তিশালি করতে কার্যকর প্রস্তাবসমূহের বিরোধিতা করছে যা তরুণ প্রজন্মকে তামাকে আসক্ত করার মাধ্যমে স্বাস্থ্য ধ্বংসের পায়তারা।
এমতাবস্থায় জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা তামাক কোম্পানির এই ভ্রান্ত প্রচারণা থেকে নীতি নির্ধারকদের সতর্ক থাকা এবং দেশের মানুষের স্বাস্থ্য রক্ষায় অবিলম্বে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন সংশোধনের মাধ্যমে শক্তিশালী করতে পদক্ষেপ গ্রহণ এবং দেশে একটি কার্যকর ও টেকসই তামাক কর ব্যবস্থা প্রবর্তণের জন্য একটি কমপ্রিহেন্সিভ তামাক কর নীতি গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন।
বিবৃতিতে মোট ১৩ জন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ স্বাক্ষর করেন। তারা হলেন, বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. গোলাম মহিউদ্দিন ফারুক; বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অব পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. আতিকুল হক; স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের উপ-উপাচার্য ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নওজিয়া ইয়াসমীন ও ডিপার্টমেন্ট অব পাবলিক হেলথের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মোঃ আনোয়ার হোসেন; ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল এবং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বিভাগীয় প্রধান (এপিডেমিওলজি) জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডাঃ সোহেল রেজা চৌধুরী; বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক ন্যাশনাল প্রফেশনাল অফিসার, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. সৈয়দ মাহফুজুল হক; স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক ডা. খালিদা ইসলাম; বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সাইন্সেসের ডিপার্টমেন্ট অবে অকুপেশনাল এন্ড এনভাইরনমেন্টাল হেলথের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. এম. এইচ. ফারুকী ও অসংক্রামক রোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক পলাশ চন্দ্র বনিক; হেলথ এন্ড হোপ হাসপাতালের চেয়ারম্যান জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী; পথিকৃৎ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী; চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. আবু জামিল ফয়সাল এবং আর্ক ফাউন্ডেশনের সিনিয়র রিসার্চ ম্যানেজার জুনায়েদ আল আজদি ও সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ডা. দীপা বড়ুয়া।

