“সকল কালের সকল দেশের সকল মানুষ আসি’
এক মোহনায় দাঁড়াইয়া শোন এক মিলনের বাঁশী।
একজনে দিলে ব্যথা—
সমান হইয়া বাজে সে বেদনা সকলের বুকে হেথা।
একের অসম্মান
নিখিল মানব-জাতির লজ্জা-সকলের অপমান।
মহা-মানবের মহা-বেদনার আজি মহা উত্থান,
ঊর্ধ্বে হাসিছে ভগবান, নিচে কাঁপিতেছে শয়তান।
(কুলি-মজুর)
কাজী নজরুল ইসলামের অমর স্মৃষ্টি। আমাদের জাতীয় অস্তিত্বে কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাঙালি জাতিসত্তার অন্যতম রূপকার। সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সকল সময় ছিল তাঁর অবস্থান। শিল্পী সত্তায় দেশপ্রেম, মানবপ্রেম এবং মানবমুক্তির তীব্র আকাঙ্ক্ষা ও গভীর উপলব্ধি ছিল তাঁর রচনায়। গবেষকদের বিবেচনায়, যুগস্রষ্টা কাজী নজরুল ইসলাম অস্তিত্বের প্রকৃত গড়ন সময়ের কামারশালায় বিশ্ব পরিস্থিতির তৎকালীন তাপ-চাপ, অমানবিকতার নিঃসংশয় নির্লজ্জ প্রকাশের পটভূমিতে।
কাজী নজরুল ইসলাম কেবল একজন কবি, ঔপন্যাসিক ও সঙ্গীতজ্ঞই নন, তিনি বাঙালি জাতীয় সত্তার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, যার সাহিত্য ও কর্ম আমাদের অস্তিত্বকে সমৃদ্ধ করেছে; তিনি ব্রিটিশবিরোধী প্রতিবাদী চেতনার প্রতীক, সাম্য, অসাম্প্রদায়িকতা ও মানবতাবাদের মূর্ত প্রতীক, এবং তার সৃষ্টিশীলতা ও জীবনদর্শন বাঙালি সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয়ের গভীরে প্রোথিত। কাজী নজরুল আমাদের আত্মার শক্তি। যে কোনো বিচারে কাজী নজরুলের বিকল্প আমাদের নেই। তার কর্মময় জীবনের শিক্ষা আমাদের জাতীয় জীবনের শিক্ষা। বাংলাদেশ, বাংলাদেশের মানুষ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং কাজী নজরুল ইসলাম অবিভাজ্য। প্রেম, দ্রোহ, সাম্য ও মানবতার কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির অন্যতম প্রাণপুরুষ। তৎকালীন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের কালে তাঁর লেখনী গোটা ভারতবর্ষের মানুষকে প্রেরণা জুগিয়েছিল। সে পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর বিদ্রোহী চেতনা ফুটে ওঠে, তিনি পরিণত হন বিদ্রোহী কবিতে।
সাম্রাজ্যবাদ, ফ্যাসিবাদ, অত্যাচার, নিপীড়ন, অনাচার, বৈষম্য, শোষণ, নির্যাতন ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে আপসহীন সাহসী কণ্ঠে সোচ্চার হয়ে কবি লিখে গেছেন অসংখ্য কবিতা, গান, গল্প, সংগীত, প্রবন্ধ, উপন্যাস ও অন্যান্য লেখা। আর সে কারণে ইংরেজ সরকার তাঁর গ্রন্থ ও রচনা বাজেয়াপ্ত করেছে এবং তাঁকে কারাদন্ডও দিয়েছে। কারাগারেও বিদ্রোহী নজরুল বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন। টানা ৪০ দিন অনশন করে ব্রিটিশ সরকারের অন্যায়-অত্যাচার জেল-জুলুমের প্রতিবাদ করেছিলেন। কবি নজরুল একটি শোষণমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক সমাজ গড়ার জন্য লড়াই করে গেছেন। তিনিই প্রথম বাঙালি কবি, যিনি পূর্ণাঙ্গভাবে ভারতের স্বাধীনতা চেয়েছিলেন। কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার অনন্য বাতিঘর। ভিন্ন ধর্মের অনেক সংগীত তাঁর লেখা। যা অসাম্প্রদায়িকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সাম্প্রদায়িকতা, কুসংস্কার, ধর্মীয় গোড়ামির বিরুদ্ধে নজরুল সব সময়ই সোচ্চার ছিলেন। সবকিছুর ঊর্ধ্বে মানুষ পরিচয়ই সবচাইতে বড় পরিচয় এই চেতনা ধারন করতেন।
স্বাধীনতার জন্য মানুষকে আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে দাঁড়াতে হবে—এই উপলব্ধি কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রথম থেকেই ছিল। অবিভক্ত ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে নজরুলের এই কথাগুলো মধ্যে প্রকারান্তরে স্থিত আছে বাঙালির লড়াকু চেতনা ও সংগ্রামী মনোভাব। কাজী নজরুল ইসলাম যে বাংলাদেশের জাতীয় কবি, আদতে তা তিনি নিজেই হয়ে উঠেছেন। কাজী নজরুল ইসলামের মধ্যে স্বাধীনতার জন্য আকাঙ্ক্ষা থেকে উচ্চারণ—সবকিছুই ছিল। নারী-পুরুষ, হিন্দু-মুসলমান—সবার ব্যক্তিক ও সামষ্টিক স্বাধীনতার কথা নজরুল বলেছেন। তাঁর আগে খুব কম বাঙালিই নারী-পুরুষের সমতা ও স্বাধীনতা নিয়ে এমনভাবে ভেবেছেন। নজরুলের সাহিত্যে যেসব মূল্যবোধ রয়েছে—সম্প্রদায়গত মিলন, মানুষের মুক্তি, নারী-পুরুষের সমতা, মানুষের স্বাধীন সত্তা—সত্যি বলতে, স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা যেসব মূল্যবোধ আকাঙ্ক্ষা করেছিলাম, তার সবকিছুই নজরুল-সাহিত্য বা নজরুলের মূল্যবোধের মধ্যে বিদ্যমান।
জীবনের শেষ অভিভাষণে নজরুল বলেছিলেন, ইসলাম ধর্মে জন্মগ্রহণ করেছেন বলেই তিনি কেবল মুসলমানের নন। সর্বমানবিকতার বোধ, তথা অন্যের মতকে গ্রহণ করার মানসিকতা তিনি সব সময় ধারণ করতেন। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসনের অবসান চেয়ে যে-নজরুল এতকিছু লিখেছেন, কারাবরণ করেছেন, জাপানকে পরাজিত করার কাজে সহায়তা করলে ব্রিটিশরা চলে যাবে সে-আশ্বাসে ব্রিটিশদের পক্ষে যুদ্ধেও গিয়েছেন, সেই তিনি ১৯৪৭-এর বিতর্কিত স্বাধীনতা ও ১৯৭১-এর বাংলাদেশের স্বাধীনতা কিছুই দেখে যেতে পারেননি, যদিও শারীরিকভাবে তিনি বেঁচে ছিলেন। এক অজানা রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯৪২ সাল থেকেই তিনি বোধশক্তি ও বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। তবে, বলতে গেলে এরপরই বাংলাদেশে নজরুল-চর্চা আরো বেগবান হয়ে ওঠে।
স্থায়ীভাবে এদেশে আসার পর প্রতি বছর কবির জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে কবিকে ফুলেল শুভেচ্ছায় সিক্ত করেছেন এদেশের মানুষ। কিন্তু সেসব ‘ফুলের জলসায়’ও নীরব ছিলেন কবি। অবশেষে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় কবিকে ঢাকার পিজি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বিশেষ মেডিকেল বোর্ড গঠন করে কবির সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এর কিছুদিন পরে ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট তিনি মৃত্যুবরণ করেন। বাংলাদেশের মানুষ কবির শেষ ইচ্ছাও পূরণ করেছে। ‘মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই’ গানটিকে স্মরণে রেখে স্মরণাতীতকালের এক বিশাল জানাজা শেষে একুশবার তোপধ্বনির মাধ্যমে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় ও সামরিক মর্যাদায় কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে দাফন করা হয়। কিন্তু আমাদের হৃদয়ে কবি কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যু নেই; এদেশের শিল্প-সংস্কৃতির মূলধারায় নজরুলের সৃষ্টিকর্ম হারাবে না তার চিরন্তন প্রবহমানতাকে। আজও তিনি বেঁচে আছেন বেঁচে থাকবেন বহুকাল তাঁর কবিতায়, আর গানে গানে।
‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে পরিচিত নজরুল নিপীড়ন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে তাঁর লেখনীর মাধ্যমে প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর তুলে ধরেছেন। তিনি সাম্য ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার মূর্ত প্রতীক, যিনি ‘কুলি-মজুর’ কবিতার মাধ্যমে সকল মানুষের অন্তর্নিহিত একাত্মতার কথা বলেছেন। নজরুলের জীবন থেকে আমরা শিখতে পারি কিভাবে কঠোর পরিশ্রম, ন্যায়ের পথে থাকা এবং প্রতিকূলতাকে জয় করা যায়। তাঁর সাহিত্য ও জীবনদর্শন বাঙালি সংস্কৃতি ও জাতীয় অস্তিত্বের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিদ্যমান, যা বাঙালি চেতনাকে চিরসবুজ ও চিরসবুজ করে রাখে।
মানবতার তূর্যবাদক কাজী নজরুল ইসলাম। আমাদের জাতীয় কবি, কারো কাছে ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো পুরুষ, আবার কারো কাছে অবিনশ্বর বিপ্লবী। তিনি আসলে এই তিনের সম্মিলন, এককথায় মানবতার বরপুত্র। এজন্য বাঙালির জীবন সাম্য ও সম্প্রীতির ঝান্ডাধারী এই কবি ছাড়া নিষ্প্রভ, বাঙালির চেতনাও ঠিক একইভাবে নিরর্থক। কাজী নজরুল ইসলামের যখন জন্ম হয়, তখন গোটা ভারতবর্ষ হাহাকারে বিক্ষুদ্ধ। একদিকে ইংরেজদের হৃদয়বিদারক অত্যাচার ও পরাধীনতার দুর্জয় জাঁতাকল, আরেকদিকে তাদেরই সৃষ্ট মৌলবাদের চোখরাঙানি। ইতিহাসের এহেন বিরুদ্ধ সময়ে জন্ম নিয়েও কীভাবে তিনি অসাম্প্রদায়িকতার স্বর্ণালী ঝাণ্ডাধারী হয়ে ওঠেন,তা আজও আমাদের ভাবায়।
অবশেষে বাংলাদেশের জাতীয় কবির রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেলেন কাজী নজরুল ইসলাম। ১৯৭২ সালের ৪ মে বাংলাদেশে আসার তারিখ থেকে তাকে বাংলাদেশের ‘জাতীয় কবি’ ঘোষণা করে গেজেট প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়েছে। কবি কাজী নজরুল ইসলামের জাতীয় কবির মর্যাদার বিষয়টি ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত সত্য এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও স্বীকৃত। বাংলাদেশের জনগণ তাকে তার ঢাকায় আগমনের তারিখ থেকে জাতীয় কবি ঘোষণা করে সরকারি প্রজ্ঞাপন প্রত্যাশা করে আসছিল। জুলাই আন্দোলনের পর বর্তমান অর্ন্তবর্তীকালিন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ এ প্রত্যাশা অনুযায়ী এ প্রস্তাব অনুমোদন করেছেন।
নজরুলের সৃষ্টিশীল কর্মজীবনের মূল সাধনা ছিল জাতি-ধর্মের-গোত্রের বিভেদমোচন। নজরুল সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় অন্যায়, অপশক্তির মূল উৎপাটনের দিকেও সচেতন মানুষের বিশেষ দৃষ্টি কামনা করেছেন এবং তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন, যে রাজশক্তি মানুষের প্রতি পাশবিক আচরণ করে, যে রাজশক্তি অগণন নারীকে বিধবা কিংবা সন্তানহারা করে, সেই রাজশক্তির ধ্বংস অনিবার্য। জাগ্রত জনতাই নজরুলের আরাধ্য ছিল। কাজী নজরুল ইসলামের চেয়ে মানবিক ঐক্যের মানুষ, অসাম্প্রদায়িক মানুষ বাঙালির ভেতরে খুব বেশি নেই। আজ আমরা যে মানব-ঐক্যের সাধনার কথা বলছি, কাজী নজরুল সেই মানব-ঐক্যের ডাক অনেক আগেই দিয়েছেন। তাঁর পথে হাটতে হবে আমাদের। আমরা যদি প্রকৃত অর্থেই বাংলাদেশে জাতীয় কবির মর্যাদা সমুন্নত করতে চাই, তাহলে দেশের প্রত্যেক মানুষের মধ্যে তাঁর মূল্যবোধের সমানুপাতিক প্রতিফলন থাকা অত্যান্ত জরুরি।