নিজস্ব প্রতিনিধিঃ আজ ১৭ জুন ২০২৫, বিকেল ৩.৩০টায় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের উদ্যোগে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের আনোয়ারা বেগম Ñমুনিরা খান মিলনায়তনে (১০,বি/১,সেগুনবাগিচা)“জাতীয় বাজেট ২০২৫-২০২৬: জেন্ডার সংবেদনশীল বাজেটের প্রতিফলন” বিষয়ক বাজেট-পরবর্তী আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
উক্ত আলোচনা সভায় সভায় সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম। স্বাগত বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পক্ষে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক শরমিন্দ নিলোর্মী (সংযুক্ত)।
সম্মানিত প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের মাননীয় সদস্য (সচিব) জনাব ড. মনজুর হোসেন। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সানেমের ডেপুটি ডিরেক্টর ইশরাত শারমিন,জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি)-এর জেন্ডার টিম লিডার শারমিন ইসলাম, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনির্ভাসিটির ইকোনেমিক্স ডিপার্টমেন্টের লেকচারার উম্মে মারজানা, বাংলাদেশ নারী শ্রমিক কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক এবং নারী কমিশনের সদস্য সুমাইয়া ইসলাম এবং দলিত নারী ফোরামের প্রকল্প কর্মকর্তা তামান্না সিং বড়াইক।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের মাননীয় সদস্য (সচিব) জনাব ড. মনজুর হোসেন বলেন,জেন্ডার বাজেট মহিলা পরিষদের দীর্ঘদিনের অ্যাডভোকেসির ফল। এবছর জেন্ডার বাজেটে বরাদ্দ বেশ কমেছে বলে এর প্রভাব কমে যাবে এটি বলা যাবে না। এবারের বাজেটে গতানুগতিকতা রক্ষা করা হয়েছে এবং অপ্রয়োজনীয় খাতগুলো বন্ধ করে দরকারি খাতগুলো রাখা হয়েছে, বাজেটের এফিসিয়েন্সি বৃদ্ধি করা হয়েছে। বাজেটের গুনগত বাস্তবায়ন গুরুত্বপূর্ণ, এজন্য মন্ত্রণালয়গুলোর প্রকল্পের গুনগত বিনিয়োগ করার দক্ষতা আছে কিনা তা দেখার বিষয়। তিনি আরো বলেন জেন্ডার বাজেট শুধুমাত্র ইনক্লুসিভলি নারীদের জন্যই করা হয়েছে এমনটি নয়। বরং জেন্ডার বাজেটের বাস্তবায়ন যেন আরো কোয়ালিটি সম্পন্ন ও বাস্তব সম্পন্ন হয় সেজন্য সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাকে সম্মিলিতভাবে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি।
বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত সানেমের ডেপুটি ডিরেক্টর ইশরাত শারমিন বলেন, জেন্ডার বাজেট নিয়ে বোঝার জায়গায় এখনো আমাদের ঘাটতি আছে। সরকারের মোট বাজেট বরাদ্দের মধ্যে জেন্ডার সংবেদনশীল খাতে বরাদ্দ কমেছে। সংকটকালীন সময়ে জেন্ডার সংবেদনশীল এর দিকগুলো গুরুত্ব কমে যায় যা একবারেই কাম্য নয়। মন্ত্রণালয়গুলো জেন্ডার বাজেটে এগিয়ে আছে বলে মনে করে অর্থ মন্ত্রণালয় কিন্তু বাস্তবে তেমন নয়। পাশাপাশি জেন্ডার বাজেটের আলোকে নারীর জীবনমানের পরিবর্তন বিষয়ে পর্যাপ্ত ডাটা সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি)-এর জেন্ডার টিম লিডার শারমিন ইসলাম বলেন, বাজেটে বরাদ্দের পর বাজেট বাস্তবায়নের পরিকল্পনা মন্ত্রনালয়গুলো কিভাবে করছে,সেই পরিকল্পনা কতটুকু কার্যকর হচ্ছে নারীর জীবনে এবং জেন্ডার বান্ধব হবে কিনা সেটি দেখতে হবে। মনিটরিং এবং পরিবীক্ষণ মূল্যায়ন এর বিষয়ে মন্ত্রণালয়গুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে এবং মনিটরিং সিস্টেম চালু করতে হবে।
ইস্ট ওয়েস্ট ইউনির্ভাসিটির ইকোনেমিক্স ডিপার্টমেন্টের লেকচারার উম্মে মারজানা বলেন, বর্তমানে পড়াশুনার খরচ বেশ ব্যয়বহুল। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত নারীরা অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী না হওয়ায় সহিংসতা বাড়ছে। এ সকল ক্ষেত্রে করণীয় বিষয়ে বাজেটে বরাদ্দ থাকতে হবে।
বাংলাদেশ নারী শ্রমিক কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক এবং নারী কমিশনের সদস্য সুমাইয়া ইসলাম বলেন, শহুরে নারী, গ্রামীণ নারী এবং অভিবাসী নারীদের কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণ কমছে সহায়তামূলক কর্মসূচি পর্যাপ্ত না থাকায়। সরকারের দেয়া বাজেটে নারীর দক্ষতা বৃদ্ধিমূলক বিষয়ে, ওয়ান স্টপ সার্ভিস বিস্তৃতি এর বিষয়ে বরাদ্দ তেমন বাড়েনি। নারীর জন্য গড়পড়তা বরাদ্দ বৃদ্ধি না করে নারীর ইতিবাচক দিককে সামনে রেখে প্রকৃত অবস্থা পর্যালোচনা করে প্রান্তিক নারীদের জন্য বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে, নারী শ্রমিকদের ডাটা সংরক্ষণ ব্যবস্থা থাকতে হবে এবং তাদের জন্য দূতাবাসগুলোতে প্রবাসী নারী শ্রমিকদের জন্য বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে।
দলিত নারী ফোরামের প্রকল্প কর্মকর্তা তামান্না সিং বড়াইক বলেন,বাংলাদেশের প্রায় ৬৫ লক্ষ দলিত জনগোষ্ঠী রয়েছে, যারা কম মজুরীতে কাজ করে যাচ্ছে। তাদের অগ্রগতির জন্য স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মক্ষেত্র সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এবং দলিত নারী ও কিশোরীদের জন্য কি ধরণের বাজেট বরাদ্দ করা হয়েছে, কিভাবে পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হবে সেই বিষয়টি বাজেটে সুস্পষ্টভাবে থাকতে হবে ।
অতিথিদের আলোচনা শেষে মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের শাহনাজ সুমী, ওয়াই ডব্লিউ সিএ অব বাংলাদেশ এর পূরবী তালুকদার; কেয়ার বাংলাদেশ এর প্রমা ইশরাত এবং মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন এর সোমা দত্ত ও মহুয়া লেয়া
স্বাগত বক্তব্যে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন,২০২৫-২০২৬ অর্থবছরে বাজেট সময় মতই ঘোষিত হয়েছে। নারী আন্দোলনের পক্ষ থেকে সুপারিশ জমা দেয়া হয়েছে যা এখন পর্যালোচনার বিষয়। জাতীয় বাজেট রাষ্ট্রের নীতিমালা বাস্তবায়নের দলিল। জেন্ডার সমতা প্রতিষ্ঠার জন্য জেন্ডার বাজেট যে গুরুত্বপূর্ণ সেটি আজ বৈশি^কভাবে স্বীকৃত, একইসাথে নারীর উন্নয়নের জন্য ও নারীর ক্ষমতায়নের জন্য বিনিয়োগের বিষয়টিও আলোচিত হচ্ছে। গত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় দেখা যাচ্ছে আগের মত সমস্ত মন্ত্রণালয়ে জেন্ডার বাজেট গৃহীত হয়নি। জেন্ডার সংবেদনশীল বাজেট বাস্তবায়নে যথাযথভাবে মনিটরিং ব্যবস্থা থাকা দরকার কিন্তু মনিটরিং সংক্রান্ত অগ্রগতি খুব বেশি দেখা যাচ্ছে না, তবে নারীর পারিবারিক অবৈতনিক শ্রমকে যে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে সেবিষয়ে তিনি ধন্যবাদ জানান।
সভাপতির বক্তব্যে ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সবসময় কনসষ্ট্রাকটিভ ভাবে বাজেট পরবর্তী আলোচনার আয়োজন করে থাকে। বাজেটে নারীর প্রতি সংবেদনশীলতা কতটুকু প্রতিফলিত হয়েছে এবং নারীর অগ্রগতি কতটুকু হয়েছে সেটি পর্যালোচনায় জন্য নারী অর্থনীতিবিদদের আরো দৃশ্যমান ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। তিনি আরো বলেন, নারীর অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজকে প্রাতিষ্ঠানিক করা যায় কিনা, বা অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজকে কাঠামোবদ্ধ করা যাবে কিনা, শিক্ষার ব্যয় কিভাবে কমানো যায় এবিষয়গুলো নিয়ে জেন্ডার বাজেটে কাজ করতে হবে। নারীর প্রতি বিদ্বেষমূলক আচরণ দূর করতে, সমাজের বৈষম্য কমাতে নতুন নতুন কাজগুলোকে বোঝা আমাদের জন্য জরুরি, তিনি সংগঠকদের প্রতি নারী আন্দোলনকে আরো গভীরে অনুধাবন করার আহ্বান জানান।

উক্ত আলোচনা সভায় এর সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির সদস্য সংগঠনের মধ্যে বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ, কেয়ার বাংলাদেশ, ওয়াই ডব্লিউ সিএ অব বাংলাদেশ; একশন এইড, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন,গণসাক্ষরতা অভিযান, প্রাগ্রস্বর-এর প্রতিনিধিবৃন্দ, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির নেত্রীবৃন্দ, সম্পাদকমন্ডলী, কর্মকর্তাবৃন্দ এবং প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকবৃন্দ সহ প্রায় শতাধিক জন উপস্থিত ছিলেন। সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের আন্দোলন সম্পাদক রাবেয়া খাতুন শান্তি।