নিজস্ব প্রতিনিধিঃ আজ ২৮ এপ্রিল ২০২৫ (সোমবার) ; সকাল ১১:২০ মিনিটে জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী মিলনায়তনে (২য় তলা), বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের উদ্যোগে সাম্প্রতিক সময়ে নারীর মানবাধিকার পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের বক্তব্য- বিষয়ক সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
লিখিত বক্তব্যে আন্দোলন সম্পাদক রাবেয়া খাতুন বলেন, দেশের সকল পর্যায়ে নারীর অবস্থান এবং অংশগ্রহণ দৃশ্যমান হলেও দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারীর সমঅধিকার, সমমর্যাদা এবং সমঅংশীদারিত্বের প্রশ্নে সমপ্রতিনিধিত্বে নারী এখনও উপেক্ষিত। দেশে নারীর অংশগ্রহণে দেশের অর্থনীতির পশ্চাৎপদতা হ্রাস পেলেও জনগণের মনোজগতে বিশেষত নারীর প্রতি নেতিবাচক, অধঃস্তন দৃষ্টিভঙ্গী এখনও বিদ্যমান। এর ফলে পারিবারিক সহিংসতা, ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণ, উত্যক্তকরণ, যৌতুক প্রথা, বাল্য বিবাহ এবং নারীর প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব প্রদর্শনের মাধ্যমে নারীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাসমূহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে নারী সমাজকে আরও অগ্রসর করে নিতে নারীর প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তনকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। পাশাপাশি নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ও নারীর মানবাধিকার সংরক্ষণে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের পাশাপাশি রাজনৈতিক দৃঢ় অঙ্গীকার ও সামাজিক সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে কয়েকটি সুপারিশ উপস্থাপন করা হয়। সুপারিশসমূহ হলো: নারী বিদ্বেষী প্রচার প্রচারণা বন্ধ করার লক্ষ্যে এর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রকে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে; নারীর প্রতি সকল প্রকার সহিংসতার দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে; মব সহিংসতার অবসান ঘটনোর জন্য যাবতীয় প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে; শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে; গণমাধ্যমকে সঠিক তথ্য উপস্থাপন নিশ্চিত করতে সংবাদ প্রচার ও প্রকাশের ক্ষেত্রে গণমাধ্যমমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে; মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর অপতৎপরতা সৃষ্টির প্রয়াস প্রতিহত করতে হবে এবং সমতাপূর্ণ সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয় নীতিমালা বিরোধী অপতৎপরতা প্রতিহত করতে হবে।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে
মডারেটরের বক্তব্যে ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, নারীর প্রতি সহিংসতা নির্মূল কেবল নারীর কাজ নয়, রাষ্ট্র ও সমাজকে নিয়ে সম্মিলিতভাবে আমাদের কাজ করতে হবে। যুগ যুগ ধরে নারীর প্রতি প্রচলিত বৈষম্যমূলক প্রথা, রীতিনীতি থেকে বের হতে না পারার ফলে আজও নারী বিদ্বেষী প্রচারণার সুযোগ তৈরি হচ্ছে, একইসাথে এই অপতৎপরতা সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চলছ্,ে এভাবে নারীকে ভয়ভীতি দেখিয়ে অবরুদ্ধ করার প্রয়াস কোনভাবেই কাম্য নয়। ৫৫ বছর আগের নারীসমাজের সাথে এখনকার নারীসমাজের পার্থক্য আছে। আজকের নারী সমাজ অধিকার সচেতন। তারা সামনে আসা বাধা মোকাবেলা করে এগিয়ে যেতে প্রস্তুত। অন্যদিকে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ৫নং লক্ষ্যমাত্রা জেন্ডার সমতা- উপেক্ষা করা কোন রাষ্ট্রের পক্ষে সম্ভব নয়, রাষ্ট্র এখানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তিনি আরো বলেন নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নারী- বিদ্বেষী সমাজ তৈরির অপচেষ্টাকে প্রতিহত করতে সংগঠন কেবল এককভাবে নয় বরং দেশের সকল মানুষকে সাথে নিয়ে সম্মিলিতভাবে প্রতিহত করবে।
সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, নারী আন্দোলনের অন্যতম দাবি অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়ন ও নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে রাজনীতিতে নারীর কার্যকর ও সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং সংসদে নারীর জন্য নূন্যতম এক তৃতীয়াংশ আসন সংখ্যা ও সরাসরি নির্বাচন- বিষয়গুলো নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনে গুরুত্ব পেয়েছে। তবে নারীর সংসদে মনোনয়নের মাধ্যমে নির্বাচিত হওয়ার চেয়ে সাময়িক সময়ের জন্য সাধারণ আসনের পাশাপাশি সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। তিনি আরো বলেন দীর্ঘদিনের নারী আন্দোলনের দাবির প্রেক্ষিতে সিডও সনদ গৃহীত হলেও বাংলাদেশ সরকার এখনো এই সনদের দুইটি ধারার উপর সংরক্ষণ বহাল রেখেছে। রাষ্ট্রকে সমতার নীতি প্রতিষ্ঠা করতে হলে রাজনৈতিক অঙ্গীকার থেকে সিডও সনদের পূর্ণ অনুমোদন সহ বৈষম্যমূলক পারিবারিক আইন সংস্কার করে অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়নের দাবি বাস্তবায়নে তৎপর হতে হবে। একই সাথে সমতার নীতি বাস্তবায়নে বাধাদানকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যও রাষ্ট্রকে তৎপর হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
উপস্থিত অন্যান্য বক্তারা বলেন, নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধের ক্ষেত্রে সংগঠন সহিংসতার শিকার নারীর পাশে থেকে তাকে কাউন্সেলিং সেবা, চিকিৎসা সেবা ও আইনী সহায়তা প্রদানের পাশাপাশি জনমত তৈরির মাধ্যমে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। দেশে মাত্র দুইটি ডিএনএ ল্যাব রয়েছে, যা তৃণমূলে ধর্ষণের শিকার নারীর তাৎক্ষণিক আইনী সহায়তা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে। বক্তারা আরো বলেন সহিংসতার মত বাল্যবিয়ে আরো একটি সামাজিক ব্যাধি। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের একটি গবেষণায় দেখা গেছে বাল্য বিয়ে কেবল দরিদ্র পরিবারেই ঘটছে এমন নয় মধ্যবিত্ত পরিবারেও বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটছে। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে কমিটি আছে, আইন আছে তবে বাস্তবে প্রয়োগ নাই। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে থাকা কমিটির জন্য বাজেট বরাদ্দ আছে কিনা দেখতে হবে, কমিটির মনিটরিং জোরদার করতে হবে; প্রশাসনিক তৎপরতা জোরদার করতে হবে; অপ্রাপ্ত বয়¯কদের কোর্ট ম্যারেজ বন্ধে রাষ্ট্রকে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, বাল্যবিয়ের কারণ চিহ্নিত করে প্রতিরোধ করতে হবে এবং নকল জন্মসনদ তৈরি বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের ও জোর দাবি জানান বক্তারা।
সংবাদ-সম্মেলনে মডারেটর হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম; সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন আন্দোলন সম্পাদক রাবেয়া খাতুন । সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেম; যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. মাসুদা রেহানা বেগম এবং আন্দোলন সম্পাদক রাবেয়া খাতুন শান্তি। সঞ্চালনা করেন কেন্দ্রীয় অ্যাডভোকেসি ও নেটওয়াকির্ং পরিচালক জনা গোস্বামী।উক্ত সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় ও ঢাকা মহানগর কমিটির নেতৃবৃন্দ, সম্পাদকমন্ডলী, কর্মকর্তাবৃন্দ ।