মো. মনিরুজ্জামান মনির-বাংলাদেশ রেলওয়ে শুধু একটি রাষ্ট্রীয় পরিবহন সংস্থাই নয়, এটি ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং একটি কর্মজীবী সমাজের অস্তিত্বের প্রতীক। যুগের পর যুগ ধরে রেলওয়ে নিজস্ব কাঠামো ও প্রশাসনের মধ্য দিয়ে পরিচালিত হয়ে এসেছে। রেলওয়ের কর্মচারী ও তাদের পরিবারগুলোর চিকিৎসা সেবা, আবাসন, শিক্ষা এমনকি পানি সরবরাহ—সব কিছু ছিল একটি সমন্বিত অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থার অংশ। অথচ, সাম্প্রতিক সময়ে আমরা একের পর এক সিদ্ধান্ত দেখছি যা রেলওয়ের সেই স্বকীয় কাঠামোকে ভেঙে দেওয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এর একটি বড় উদাহরণ হচ্ছে রেলওয়ে হাসপাতালগুলোর যৌথ ব্যবস্থাপনায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালনার সিদ্ধান্ত।
২১ এপ্রিল ২০২৫ তারিখে রেলপথ মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। এতে সিদ্ধান্ত হয়, রেলওয়ের অধীনে থাকা ১০টি হাসপাতাল এখন থেকে যৌথভাবে পরিচালিত হবে। এই হাসপাতালগুলো ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, লালমনিরহাট, সৈয়দপুর, পার্বতীপুর, সান্তাহারসহ গুরুত্বপূর্ণ রেলওয়ে অঞ্চলে অবস্থিত।
চুক্তির আওতায় হাসপাতালগুলোতে সাধারণ জনগণের চিকিৎসা সেবা উন্মুক্ত করা হবে এবং একটি কেন্দ্রীয় পরিচালনা কমিটির অধীনে সেগুলো চলবে। একই সঙ্গে প্রতিটি হাসপাতালের জন্য একটি স্থানীয় যৌথ ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠিত হবে—যার মধ্যে উভয় মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি থাকবে।
এই সিদ্ধান্ত যাদের কাছে বাহ্যিকভাবে একটি উন্নয়ন পরিকল্পনা মনে হচ্ছে, তাদের জন্য বিষয়টি পরিষ্কার করে বলা প্রয়োজন। এটি কেবল রেলওয়ের একটি প্রতিষ্ঠানকে নয়, একটি প্রতিষ্ঠানের ভিতকেই দুর্বল করে ফেলার কৌশল মাত্র।
রেলওয়ের হাসপাতালগুলো দীর্ঘদিন ধরে শুধু চিকিৎসাসেবা দেয়নি, তারা ছিল একটি সামাজিক সুরক্ষা কাঠামোর গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীদের পরিবারগুলোর স্বাস্থ্যসেবার একমাত্র নির্ভরশীল প্রতিষ্ঠান ছিল এই হাসপাতালগুলো। এখন যৌথ ব্যবস্থাপনার নামে এই হাসপাতালগুলো যদি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়, তবে রেলওয়ে কর্মচারীদের সুযোগ-সুবিধা কি আগের মতোই বহাল থাকবে? নাকি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন অন্যান্য হাসপাতালের মতোই অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হবে?
আমরা জানি, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত অধিকাংশ হাসপাতালেই চিকিৎসা সংকট, অব্যবস্থাপনা এবং স্বজনপ্রীতির অভিযোগ রয়েছে। সেই কাঠামোকে রেলওয়ের ওপর চাপিয়ে দিলে কীভাবে সেবা উন্নত হবে, তা স্পষ্ট নয়।
এছাড়া, স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নিজেই জানিয়েছেন দেশে বর্তমানে ৮,০০০ চিকিৎসকের ঘাটতি রয়েছে। সম্প্রতি ২,০০০ চিকিৎসক নিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, কিন্তু এই সংখ্যায়ও সারাদেশের জন্য পর্যাপ্ত চিকিৎসা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। এমন পরিস্থিতিতে রেলওয়ের হাসপাতালগুলোকে সেবা সম্প্রসারণের নামে সাধারণ জনগণের জন্য উন্মুক্ত করা বাস্তবে এক নতুন চাপে পরিণত হবে, যা রেলকর্মচারীদের জন্য সেবার মান হ্রাস এবং অপেক্ষাকৃত অবহেলিত আচরণের শঙ্কা তৈরি করবে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নিয়ন্ত্রণ। রেলওয়ের প্রতিটি বিভাগে যেমন যোগাযোগ, সিগন্যালিং, মেরামত, পানি সরবরাহ, এমনকি সড়ক ব্যবস্থাপনাও ছিল রেলওয়ের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায়। এখন একে একে এসব কার্যক্রম অন্য সংস্থার হাতে দেওয়া হচ্ছে। পানি সরবরাহের দায়িত্ব ওয়াসাকে দেওয়া হয়েছে, রেলওয়ে ভূমিতে রাস্তা নির্মাণ করছে সিটি করপোরেশন, আর এখন হাসপাতাল পরিচালনাও চলে যাচ্ছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হাতে। এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে একটি স্বাধীন স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা একে একে ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
রেলওয়ের কর্মচারীরা আজ প্রশ্ন করতে চায়—এই সিদ্ধান্তগুলো কার স্বার্থে নেওয়া হচ্ছে? রেলওয়ের ইতিহাস, স্বকীয়তা এবং কর্মজীবীদের অধিকারকে পাশ কাটিয়ে যারা এসব সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, তারা কি রেলওয়ের দীর্ঘমেয়াদি ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো চিন্তা করছেন?
একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে যুগোপযোগী করতে গেলে আধুনিকায়ন প্রয়োজন, কিন্তু আধুনিকায়নের অর্থ কখনোই স্বকীয়তা ধ্বংস করা নয়। বরং তা হওয়া উচিত দক্ষতা, মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং স্বচ্ছতা বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটিকে আরও শক্তিশালী করা। অথচ আমরা আজ যা দেখছি, তা ঠিক তার বিপরীত—রেলওয়েকে দুর্বল, নির্ভরশীল এবং ক্ষুদ্র স্বার্থের খেলায় ব্যবহৃত একটি যন্ত্রে পরিণত করা হচ্ছে।
এই মুহূর্তে সময় এসেছে রেলওয়ের এই ধ্বংসের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার। রেলপথ উপদেষ্টা থেকে শুরু করে রেল মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা—কেউই দায় এড়াতে পারেন না। তাদের নীরবতাই এখানে পৃষ্ঠপোষকতার কাজ করছে। ফলে রেলওয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হচ্ছে।
রেলওয়ে কর্মচারী ও পোষ্যদের পক্ষ থেকে আমাদের স্পষ্ট দাবি—এই সিদ্ধান্তগুলো পুনর্বিবেচনা করতে হবে। রেলওয়ে হাসপাতালগুলোর ব্যবস্থাপনা রেলওয়ের কর্মচারীদের অধিকার ও প্রয়োজন অনুযায়ী পরিচালিত হতে হবে। যৌথ ব্যবস্থাপনার নামে যদি সেবা হরণ ও নিয়ন্ত্রণ হারানোর প্রক্রিয়া চলে, তবে তা কখনোই গ্রহণযোগ্য হবে না।
আমরা চাই রেলওয়ে হোক আধুনিক, দক্ষ, মানবিক একটি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু তা যেন হয় রেলওয়ের নিজস্ব কাঠামো ও আত্মমর্যাদার ভিত্তিতে, বাইরের চাপ বা সুবিধাভোগীদের প্রভাবের দ্বারা নয়।