রুপসীবাংলা৭১ অন্যান্য ডেস্ক : আদম (আ.) ও হাওয়া (আ.)-কে জান্নাত থেকে অবতরণ করতে বাধ্য করার মূল কারণ ছিল শয়তান, হাওয়া নন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘অতঃপর শয়তান তাদের সেখান থেকে পদস্খলন ঘটাল এবং তারা যে অবস্থায় ছিল তা থেকে তাদের সরিয়ে দিল…।’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ৩৬)
আয়াতে ‘তাদের’ শব্দটি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয় যে শয়তান একা হাওয়াকে নয়, বরং আদম ও হাওয়া দুজনকেই বিভিন্নভাবে প্ররোচিত করার চেষ্টা করে। ফলে উভয়েই শয়তানের কুমন্ত্রণায় নিষিদ্ধ বৃক্ষের কাছে গিয়েছিলেন।
কোরআনের আরেক আয়াতে আল্লাহ তাআলা মানুষকে সতর্ক করে বলেন, ‘নিশ্চয়ই শয়তান তোমাদের শত্রু। অতএব, তোমরাও তাকে শত্রু হিসেবে গ্রহণ করো; সে তার দলকে আহবান করে, যেন তারা জাহান্নামবাসীদের অন্তর্ভুক্ত হয়।’ (সুরা : ফাতির, আয়াত : ৬)
শয়তানের ক্ষমতা শুধু কুমন্ত্রণা ও প্রলোভন পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। সে কাউকে জোর করে পাপ করাতে পারে না।
মানুষই তার স্বাধীন ইচ্ছায় সিদ্ধান্ত নেয়—শয়তানের ফাঁদে পড়বে কি না। শয়তানের এ হিংসা আদম (আ.)-এর সৃষ্টির মুহূর্ত থেকেই শুরু হয়েছিল আর এই বৈরিতাই পরবর্তী সময়ে জান্নাত থেকে তার বের হওয়ার কারণ হয়েছিল।
কোরআনের আরেকটি আয়াতে আল্লাহ তাআলা পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছেন—আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করার মূল উদ্দেশ্য ছিল তাঁকে পৃথিবীতে নিজের প্রতিনিধি (খলিফা) হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। তাই বলা যায়, আদম (আ.)-এর পৃথিবীতে আগমন ছিল আল্লাহর পরিকল্পনারই অংশ।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর যখন তোমার প্রতিপালক ফেরেশতাদের বললেন—আমি তো পৃথিবীতে একজন প্রতিনিধি নিয়োগ করতে যাচ্ছি…।’
(সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ৩০)
এই আয়াত স্পষ্ট করে যে আদম (আ.)-এর পৃথিবীতে অবতরণ ছিল আল্লাহর নির্ধারিত একটি উদ্দেশ্যমূলক সিদ্ধান্ত, যেখানে তিনি মানবজাতিকে পৃথিবীর খলিফা হিসেবে বসবাস করাতে চেয়েছিলেন। অন্যদিকে যে আয়াতে বলা হয়েছে শয়তান তাদের পদস্খলিত করেছিল—এটি আসলে এই অর্থে যে শয়তানের কুমন্ত্রণা ছিল আদম (আ.)-এর ভুলের তাৎক্ষণিক কারণ, যার ফলে তাকে জান্নাত থেকে পৃথিবীতে পাঠানো হয়। তবে সেটা আল্লাহরই পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনার বাস্তবায়ন। এভাবে দুটি আয়াত একে অপরের পরিপূরক : খলিফা হিসেবে পাঠানো আল্লাহর সিদ্ধান্ত আর অবতরণের তাৎক্ষণিক কারণ ছিল শয়তানের প্ররোচনা।
আল্লাহ তাআলা যখন আদম (আ.) ও হাওয়া (আ.)-কে সৃষ্টি করলেন, তখন শয়তান কিভাবে তাদের প্ররোচনা দিয়ে জান্নাত থেকে অবতরণে বাধ্য করেছিল—এ নিয়ে তাফসিরবিদদের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা রয়েছে। প্রথমত, আদম (আ.) যেই জান্নাতে ছিলেন তার পরিচয় নিয়ে পণ্ডিতদের দুটি মত আছে :
১. অনেক আলেমের মতে, এটি সেই প্রকৃত জান্নাত, যেখানে মুমিনরা পরকালে চিরকাল বসবাস করবে।
২. অন্য একদল আলেমের মতে, এটি ছিল ভিন্ন ধরনের এক জান্নাত—বিশেষভাবে আদম (আ.)-এর জন্য প্রস্তুত, যার প্রকৃতি ও অবস্থান আমরা সঠিকভাবে জানি না। তবে আল্লাহ তাআলা তাঁদের জান্নাতের সব নিয়ামত ও ফল-মূল ভোগ করার পূর্ণ অনুমতি দিয়েছিলেন—শুধু একটি নির্দিষ্ট গাছ ছাড়া। আল্লাহ পরিষ্কারভাবে তাদের সে গাছের ফল খেতে নিষেধ করেন এবং সতর্ক করেছিলেন যে এর নিকটে গেলেও তারা বিপদে পড়বে। এই নিষিদ্ধ গাছটির স্বরূপ নিয়েও তাফসিরবিদদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেছেন, এটি ছিল ‘জ্ঞানবৃক্ষ’। অন্যরা বলেছেন, এটি ছিল ‘গমের গাছ’। কোরআন এ সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু বলেনি, তাই এর প্রকৃতি জানা মানবজাতির জন্য জরুরি নয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে আদম! তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস করো এবং যা ইচ্ছা সেখান থেকে স্বচ্ছন্দে খাও; কিন্তু এই গাছের নিকটে যেয়ো না, নয় তো তোমরা জালিমদের অন্তর্ভুক্ত হবে।’ (সুরা: বাকারাহ, আয়াত : ৩৫)
আয়াতে ‘এই গাছ’ বলে নির্দিষ্টরূপে উল্লেখ করা হয়েছে—যা প্রমাণ করে যে গাছটি স্পষ্টভাবে তাঁদের সামনে চিহ্নিত ও পরিচিত ছিল। আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—আল্লাহ শুধু গাছের ফল খেতেই নিষেধ করেননি; গাছটির কাছেও না যেতে নির্দেশ দিয়েছেন। কারণ নিষিদ্ধ জিনিসের নিকটবর্তী হওয়া মানুষের ইচ্ছাশক্তিকে দুর্বল করে এবং তাকে সহজেই ভুলের পথে টেনে নিয়ে যায়। তাই প্রতিরোধের প্রথম ধাপই হলো—নিষিদ্ধের পরিবেশ ও কাছাকাছি যাওয়া থেকে বিরত থাকা।
শয়তান তখন তার কুমন্ত্রণা ও কৌশল শুরু করে। প্রথমে সে আদম (আ.)-এর কাছে বারবার আসে, দীর্ঘ সময় কথা বলে, যেন কোনো জ্ঞানী ও বিশ্বস্ত উপদেষ্টা—এভাবে ধীরে ধীরে তার কাছে পরিচিত ও গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। এরপর সে নিষিদ্ধ গাছটিকে তাঁদের চোখে সুন্দর ও আকর্ষণীয় করে তুলে ধরে—যেমন সে সব সময়ই মানুষকে পাপকে সুন্দর করে দেখায়। কিন্তু আদম (আ.) প্রথমে এসব প্ররোচনায় প্রভাবিত হননি। তিনি আল্লাহর নিষেধ স্মরণ রেখে গাছটির কাছে যাননি এবং জান্নাতের অন্যান্য ফল-মূল থেকেই আহার করতে থাকলেন। তখন শয়তান অন্য দিক দিয়ে তাঁর কাছে এলো। সে মানুষের মনের গভীরে থাকা দুটি স্বাভাবিক আকাঙ্ক্ষাকে লক্ষ্য করল—চিরজীবন লাভের বাসনা এবং ক্ষমতা বা মর্যাদার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। এই দুটি বিষয়ই মানুষকে সহজে প্রলুব্ধ করতে পারে। আল্লাহ তাআলা বলেন, “অতঃপর শয়তান তাকে কুমন্ত্রণা দিয়ে বলল : ‘হে আদম! আমি কি তোমাকে অমরত্বের গাছ এবং এমন এক রাজ্যের সন্ধান দেখাব, যা কখনো নষ্ট হবে না?’” (সুরা : ত্বাহা, আয়াত : ১২০)
আদম (আ.) ও হাওয়া (আ.) মনে করেছিলেন—এই গাছের ফল খেলে হয়তো তাঁরা অমরত্ব ও স্থায়ী মর্যাদা অর্জন করবেন। তবু তাঁরা গাছটির কাছে যেতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত শয়তান আদম (আ.) ও হাওয়া (আ.)-কে শপথ করে বলল—যেমনটি কোরআনে উল্লেখ আছে : সে তাদের কাছে শপথ করে বলল, ‘নিশ্চয়ই আমি তোমাদের হিতাকাঙ্ক্ষীদের একজন।’
(সুরা : আরাফ, আয়াত : ২১)
শয়তান আল্লাহর নামে শপথ করায় আদম (আ.) মনে করলেন—কেউ আল্লাহর নামে তো মিথ্যা বলতে পারে না। ওপরন্তু শয়তান তাকে বোঝাল যে সে আদমের আগেই সৃষ্টি হয়েছে, তাই সে বেশি জানে। সব মিলিয়ে আদম (আ.) তার কথায় আস্থা রাখলেন এবং নিষিদ্ধ গাছের ফল খেয়ে ফেললেন। ফল খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহ তাআলার পর্দা সরে গেল এবং তাঁদের লজ্জাস্থান দুজনের কাছেই স্পষ্ট হয়ে উঠল। তাঁরা তৎক্ষণাৎ জান্নাতের গাছের পাতা জুড়ে নিজেদের আচ্ছাদিত করতে লাগলেন। নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে তাঁরা গভীর অনুতপ্ত হন এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। তখন আল্লাহ তাওবা কবুল করেন। আল্লাহ বলেন : ‘অতঃপর আদম তার রবের কাছ থেকে কিছু শব্দ প্রাপ্ত হলেন এবং আল্লাহ তার তাওবা কবুল করলেন। নিশ্চয়ই তিনি তাওবার গ্রহণকারী, পরম দয়ালু।’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ৩৭)
এরপর আল্লাহ তাআলা তাঁদের জান্নাত থেকে পৃথিবীতে অবতরণ করার নির্দেশ দিলেন, যেখানে তাঁরা মানবজাতির প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। পৃথিবীতে বসবাস, তার তত্ত্বাবধান এবং পরবর্তী বংশধরদের মধ্যে নেতৃত্বের দায়িত্ব প্রদান—এটাই ছিল মানবজাতিকে সৃষ্টি করার হিকমত ও উদ্দেশ্য।
যখন আল্লাহ তাআলা আদম (আ.)-এর মর্যাদা ও জ্ঞান প্রকাশ করলেন—যে নামগুলো তিনি আদমকে শিখিয়েছিলেন এবং যেগুলো ফেরেশতারা জানত না, তখন তিনি ফেরেশতাদের আদেশ দিলেন আদমের সামনে সিজদা করতে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে আদম! তাদের নামগুলো জানিয়ে দাও।’ আর যখন আদম তাদের নামগুলো জানিয়ে দিলেন, তখন আল্লাহ বললেন, ‘আমি কি তোমাদের বলিনি যে আমি আসমান ও জমিনের অদৃশ্য বিষয় জানি? আমি জানি তোমরা যা প্রকাশ করো এবং যা গোপন করো।’
আর যখন আমরা ফেরেশতাদের বললাম, ‘আদমকে সিজদা করো, তখন তারা সবাই সিজদা করল—শুধু ইবলিস ছাড়া, যে অস্বীকার করল, অহংকার করল এবং কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল।’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ৩৩-৩৪)
ইবলিস তার অমান্যতার কারণ হিসেবে যুক্তি দেখাল যে সে আদমের চেয়ে উত্তম—কারণ সে আগুন থেকে সৃষ্টি, আর আদম (আ.) মাটি থেকে। কোরআনে বলা হয়েছে : ‘তিনি বলেন : আমি তো তার চেয়ে উত্তম। তুমি আমাকে আগুন থেকে সৃষ্টি করেছ, আর তাকে সৃষ্টি করেছ মাটি থেকে।’ (সুরা : আরাফ, আয়াত : ১২)
এই অহংকারই তাকে অবাধ্যতা, অভিশাপ ও জান্নাত থেকে বহিষ্কারের দিকে ঠেলে দেয়। কোরআনে এসেছে, তিনি (আল্লাহ) বলেন, ‘এখান থেকে বের হয়ে যাও—অপমানিত ও বিতাড়িত হয়ে। তোমার অনুসরণকারী যারা থাকবে, আমি অবশ্যই তোমাদের সবাইকে দিয়ে জাহান্নাম পূর্ণ করবই।’ (সুরা : আরাফ, আয়াত : ১৮)
রুপসীবাংলা৭১/এআর

