রুপসীবাংলা৭১ অন্যান্য ডেস্ক : তারা ছিলেন মহাকাশ অভিযানের পথিকৃৎ—১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে অ্যাপোলো মিশনের মাধ্যমে চাঁদের উদ্দেশে যাত্রা করা ২৪ জন নাসা নভোচারী। অ্যাপোলো ১৩ মিশনের কমান্ডার জিম লাভেল মারা যাওয়ার পর, এখন মাত্র পাঁচজন জীবিত আছেন। তারা পৃথিবীর কক্ষপথ ছাড়িয়ে গভীর মহাকাশে পা রেখেছিলেন।
১৯৭০ সালে ভয়াবহ যান্ত্রিক ত্রুটির পরও অ্যাপোলো ১৩ মিশনকে নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনার নেতৃত্ব দেন জিম লাভেল।
তার মৃত্যু মহাকাশ ভ্রমণের এক যুগের অবসানকে আরো বাস্তব করে তুলেছে। অর্ধশতকের বেশি সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর চাঁদে আবার মানুষ পাঠানোর প্রতিযোগিতা নতুন করে উত্তেজনা তৈরি করেছে।
নাসার আর্তেমিস কর্মসূচির লক্ষ্য হলো এই দশকের মধ্যেই চাঁদে মানুষের স্থায়ী উপস্থিতি নিশ্চিত করা। অন্যদিকে চীন ২০৩০ সালের মধ্যে চাঁদের মাটিতে মানুষ পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে।
তারা ২০২৪ সালের জুনে চাঁদের অদৃশ্য পাশে সফলভাবে একটি প্রোব অবতরণ করিয়েছে। এদিকে বেসরকারি মহাকাশ সংস্থাগুলোও চাঁদে বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি পাঠাতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, যদিও ব্যর্থতার সংখ্যাই বেশি।
নাসা পরিকল্পনা করেছিল ২০২৪ সালে আর্তেমিস-২ মিশনে চাঁদে মানুষ পাঠাবে—১৯৭২ সালের অ্যাপোলো ১৭-এর পর এটিই হতো প্রথম মানবযাত্রা। কিন্তু প্রস্তুতির ঘাটতির কারণে তা ২০২৬ পর্যন্ত পিছিয়ে গেছে।
এ ছাড়া স্পেসএক্স ও বোয়িংয়ের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোও নিজস্ব প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে, যদিও তারা নানা সমস্যায় ভুগছে। বোয়িংয়ের স্টারলাইনার ক্যাপসুলের সমস্যার কারণে দুই নভোচারী আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে আটকে পড়া ছিল সংস্থাটির জন্য বড় এক বিব্রতকর পরিস্থিতি। অন্যদিকে, স্পেসএক্সের স্টারশিপ রকেটের বিস্ফোরণ এখন যেন মহাকাশ পর্যবেক্ষকদের কাছে স্বাভাবিক দৃশ্য।
এসব বিলম্বের মধ্যেই স্পষ্ট হচ্ছে—অ্যাপোলো যুগের নভোচারীদের সংখ্যা দ্রুত কমে আসছে। অ্যাপোলো ৮ মিশনে জিম লাভেল, ফ্রাংক বোরম্যান ও বিল অ্যান্ডারস ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন।
তারাই প্রথম মানুষ, যারা চাঁদের কক্ষপথে ঘুরে এসেছিলেন এবং নাসার পরবর্তী মিশনের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও জীবনধারণ ব্যবস্থার পরীক্ষা করেছিলেন।
তাদের মহাকাশযান চাঁদের চারপাশে ১০ বার প্রদক্ষিণ করেছিল, এরপর তারা নিরাপদে ফিরে আসেন। পরবর্তী সময়ে জিম লাভেল অ্যাপোলো ১৩ মিশনের কমান্ডার হিসেবে চাঁদে পা রাখা পঞ্চম ব্যক্তি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ওই মিশনের দুর্ঘটনার কারণে তা সম্ভব হয়নি। তবে তার সেই জীবন-মৃত্যুর সীমানায় থাকা অভিজ্ঞতা পরবর্তী সময়ে জনপ্রিয় সিনেমা ‘অ্যাপোলো ১৩’-এ চিত্রায়িত হয়, যেখানে লাভেলের চরিত্রে অভিনয় করেন টম হ্যাংকস।
১৯৭৩ সালে নাসা থেকে অবসরের পর লাভেল টেলিযোগাযোগ শিল্পে কাজ করেন। তার স্ত্রী মেরিলিন, যিনি অ্যাপোলো ১৩ দুর্ঘটনার সময় গণমাধ্যমের নজর কাড়েন। তিনি ২০২৩ সালের আগস্টে মারা যান। এখন প্রশ্ন হলো—বেঁচে থাকা পাঁচজন চাঁদ-যাত্রী কারা? তারা এখন কী করছেন? এই চাঁদ বিজয়ীদের গল্প এখন আরো মূল্যবান—কারণ, তারা ধীরে ধীরে ইতিহাস হয়ে উঠছেন।
১৯৬৯ সালের ২১ জুলাই, সাবেক ফাইটার পাইলট এডউইন বাজ অলড্রিন তার চন্দ্রযান থেকে বেরিয়ে এসে চাঁদের পৃষ্ঠে পদার্পণ করা দ্বিতীয় মানুষ হন। এর প্রায় ২০ মিনিট আগে তার কমান্ডার নিল আর্মস্ট্রং প্রথম ব্যক্তি হিসেবে চাঁদে পা রাখেন। অলড্রিনের প্রথম কথা ছিল— ‘দারুণ সুন্দর দৃশ্য।’ আর্মস্ট্রং জিজ্ঞেস করলেন, ‘এটা কি অসাধারণ কিছু নয়? এখান থেকে দৃশ্যটা অসাধারণ।’ অলড্রিন জবাব দিলেন, ‘অসাধারণ এক শূন্যতা।’
বাজ অলড্রিন (ডান দিকে) সঙ্গে তার ক্রুমেট নিল আর্মস্ট্রং এবং মাইকেল কলিন্সের। চাঁদে তাদের অভিযানের আগে। ছবি : নাসা
দ্বিতীয় হওয়ার বিষয়টি তাকে কখনো পুরোপুরি স্বস্তি দেয়নি। তার সহকর্মী মাইকেল কলিন্স বলেছিলেন, ‘অলড্রিন প্রথম হতে না পারার কষ্ট বেশি পেয়েছিলেন।’ তবুও অলড্রিন তার কৃতিত্ব নিয়ে গর্বিত ছিলেন। বহু বছর পর, যখন এক ব্যক্তি দাবি করলেন অ্যাপোলো ১১ ছিল এক বিশাল প্রতারণা। তখন ৭২ বছর বয়সী অলড্রিন তার চোয়ালে ঘুষি মেরেছিলেন ।
২০১২ সালে নীল আর্মস্ট্রংয়ের মৃত্যুতে অলড্রিন বলেছিলেন, ‘আমি জানি, সারা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের সঙ্গে আমিও এক সত্যিকারের মার্কিন নায়ক এবং আমার জানা সেরা পাইলটের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করছি।’ পরে জীবনে নানা সংগ্রামের মধ্যেও তিনি অভিযানের নেশা হারাননি। তিনি উত্তর ও দক্ষিণ মেরু উভয় জায়গায় অভিযানে অংশ নেন— দক্ষিণ মেরুর অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন ৮৬ বছর বয়সে।
খ্যাতি উপভোগের পাশাপাশি তিনি মহাকাশ কর্মসূচির সমর্থক হিসেবে সক্রিয় থেকেছেন। বিশেষ করে, মঙ্গলগ্রহ অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে। তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় না আমাদের শুধু মঙ্গলে গিয়ে ফিরে আসা উচিত— অ্যাপোলো প্রগ্রামে আমরা সেটাই করেছি।’
তার নাম নতুন প্রজন্মের কাছেও পরিচিত হয়ে উঠেছে টয় স্টোরি চলচ্চিত্র সিরিজের চরিত্র ‘বাজ লাইটইয়ারের’ অনুপ্রেরণা হিসেবে। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে, ৯৩ বছর বয়সে তিনি চতুর্থবারের মতো বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।
চাঁদে পা রাখা জীবিত মাত্র চারজন মানুষের মধ্যে একজন হলেন চার্লি ডিউক। ৩৬ বছর বয়সে তিনি এই কৃতিত্ব অর্জন করেন, যা তাকে চাঁদের পৃষ্ঠে পা রাখার সর্বকনিষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত করেছে। এক বিবিসির সাক্ষাৎকারে তিনি চাঁদের ভূখণ্ডকে ‘অসাধারণ’ হিসেবে বর্ণনা করেন।
অ্যাপোলো ১১ মিশনের সময় মিশন কন্ট্রোলে চার্লি ডিউক (বাঁয়ে) পাশে জিম লাভেল এবং ফ্রেড হাইস। ছবি : নাসা
তিনি বলেন, ‘এর সৌন্দর্য… মহাকাশের কালো অন্ধকার আর চাঁদের দিগন্তের মধ্যে তীব্র বৈপরীত্য… আমি কখনো ভুলব না। এটা ছিল অত্যন্ত নাটকীয়।’ তবে, ১৯৬৯ সালে অ্যাপোলো ১১ চাঁদে অবতরণের পর নাসার মিশন কন্ট্রোলে ক্যাপসুল কমিউনিকেটর (ক্যাপকম) হিসেবে তার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। সেই সময় নিল আর্মস্ট্রং বলেছিলেন, ‘হিউস্টন, ট্রাংকুইলিটি বেস এখানে। ইগল অবতরণ করেছে।’
ডিউক তার স্বতন্ত্র দক্ষতা ও দক্ষিণী উচ্চারণে উত্তরে বলেছিলেন, ‘রজার, ট্রাংকুইলিটি। আমরা তোমাদের গ্রাউন্ড থেকে কপি করছি। এখানে এমন অনেকেই আছেন যারা শ্বাস আটকে রেখেছিল, আমরা আবার শ্বাস নিচ্ছি।’
তিনি পরে বিবিসিকে বলেন, ‘আমি সত্যিই তা অনুভব করছিলাম, শেষ মিনিটগুলোতে শ্বাস আটকে রেখেছিলাম।’ ২০২২ সালে ডিউক বিবিসিকে জানান, তিনি নাসার আর্টেমিস মিশন নিয়ে উত্তেজিত, তবে সতর্ক করেন নতুন প্রজন্মের নভোচারীদের জন্য এটি কঠিন হবে।
তিনি বলেন, ‘তারা অবতরণের জন্য চাঁদের দক্ষিণ মেরুর কাছে জায়গা বেছে নিয়েছে, কারণ সেখানে যদি বরফ থাকে, তা ওই অঞ্চলে থাকবে। এটা কঠিন হবে। কিন্তু আমরা সফল হব।’ বর্তমানে চার্লি ডিউক টেক্সাসের সান অ্যান্টোনিওর বাইরে স্ত্রী ডরোথির সঙ্গে বসবাস করছেন, যাদের বিবাহিত জীবন চলছে ৬০ বছর ধরে।
ফ্রেড হাইস ছিলেন ১৯৭০ সালের অ্যাপোলো ১৩ মিশনের একজন সদস্য, যা মহাকাশযানের ভেতরে বিস্ফোরণের কারণে বিপদ থেকে শুধু রক্ষা পায়। এই বিস্ফোরণের পর মিশন বাতিল করা হয়, তখন যানটি পৃথিবী থেকে প্রায় ২ লাখ মাইল (৩২১০০০ কিলোমিটার) দূরে ছিল।
পুরো বিশ্ব উৎকণ্ঠিত চোখে দেখছিল, যখন নাসা ক্ষতিগ্রস্ত মহাকাশযান এবং তার ক্রুদের নিরাপদে ফেরানোর চেষ্টা করছিল। সফলভাবে ফেরার পর হাইস, জেমস লাভেল এবং জ্যাক সুইগার্ট জনসাধারণের কাছে এক ধরনের সেলিব্রিটি হয়ে ওঠেন।
টক শো হোস্ট জনি কারসনের সঙ্গে ‘দ্য টুনাইট শো’-তে যোগ দেওয়ার সময় হাইস বলেছিলেন, ‘আমার মনে হয় আমি ওখানে কিছু মিস করেছি।’ হাইস কখনো চাঁদে যেতে পারেননি। যদিও তিনি অ্যাপোলো ১৯ মিশনের কমান্ডার হওয়ার কথা ছিল। মিশনটি বাজেট কাটছাঁটের কারণে বাতিল হয়ে যায়, একই সঙ্গে অ্যাপোলো ১৭-এর পরের সব মিশনও বাতিল হয়।
পরবর্তী সময়ে তিনি প্রোটোটাইপ স্পেস শাটল ‘এন্টারপ্রাইজ’-এর পরীক্ষক পাইলট হিসেবে কাজ করেন। অ্যাপোলো প্রকল্পের অন্যান্য সদস্যদের মতো নাসা থেকে বের হওয়ার পর হাইস মহাকাশ ও বিমান ক্ষেত্রের শিল্পে কাজ চালিয়ে গেছেন অবসর গ্রহণের আগ পর্যন্ত।
সেই সময়ের অন্য বেশির ভাগ নভোচারীর মতো মার্কিন সেনাবাহিনীতে পাইলট হিসেবে কাজ না করে হ্যারিসন স্কিমিট ছিলেন একজন ভূতত্ত্ববিদ ও শিক্ষাবিদ। তিনি নাসার অন্যান্য নভোচারীর ভূতাত্ত্বিক চন্দ্র অভিযানের জন্য প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন এবং ১৯৬৫ সালে নিজেই একজন বিজ্ঞানী-নভোচারী হন।
স্কিমিট ছিলেন চাঁদের শেষ মানব অভিযান অ্যাপোলো ১৭-এর সদস্য। যেখানে কমান্ডার ইউজিন সের্নানের সঙ্গে তিনি ১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাসে চাঁদের পৃষ্ঠে পা রাখা শেষ দুই মানুষের একজন।
নাসা ছাড়ার পর ১৯৭৫ সালে তিনি তার নিবাস নিউ মেক্সিকো থেকে মার্কিন সেনেটে নির্বাচিত হন। কিন্তু মাত্র একবার মেয়াদ পূর্ণ করেন। এরপর বিভিন্ন শিল্প খাতে পরামর্শদাতা হিসেবে এবং একাডেমিক কাজে নিয়োজিত আছেন। তিনি জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক সমঝোতার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কথা বলার জন্যও পরিচিত।
অ্যাপোলো ১৫-এর কমান্ডার ডেভিড স্কট হলেন জীবিত মাত্র চারজন চাঁদে হাঁটা মানুষের একজন এবং তিনি চাঁদে গাড়ি চালানোর প্রথম ব্যক্তিদের একজনও।
১৯৭১ সালে স্কট ও তার ক্রু সদস্য জেমস ইরউইন লুনার রোভিং ভেহিকেল (এলআরভি) পরীক্ষা করেন, যা ‘ম্যান’স ফার্স্ট হুইল’ নামে পরিচিত। ঘণ্টায় প্রায় ৮ মাইল (১২ কিমি) বেগে চলতে সক্ষম এই যান নভোচারীদের চাঁদের ল্যান্ডার থেকে অনেক দূর দ্রুত ভ্রমণের সুযোগ দেয়।
স্কট স্মরণ করে বলেন, ‘প্রথম মিশনে কখনো নিশ্চিত হওয়া যায় না এটা কাজ করবে কি না। সবচেয়ে আনন্দের মুহূর্ত ছিল গাড়িটি চালু করে দেখতে পাওয়া যে এটা ঠিকমতো কাজ করছে।’
চাঁদ থেকে ফিরে নাসায় বিভিন্ন ব্যবস্থাপনা পদে কাজ করেছেন তিনি। এরপর বেসরকারি খাতে যোগ দেন। তিনি বিভিন্ন চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন প্রজেক্টের পরামর্শদাতা হিসেবেও কাজ করেছেন। পরবর্তী প্রজন্মের চাঁদের অভিযাত্রীরা কী অর্জন করবে, তা আগ্রহের বিষয়।
সূত্র : বিবিসি
রুপসীবাংলা৭১/এআর