নিজস্ব প্রতিনিধিঃ জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ও অংশগ্রহণে একটি শক্তিশালী তদন্ত কমিটি গঠন করে হামলার ঘটনা তদন্তপূর্বক দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিসহ ৫দফার দাবি
গত ১৯-২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা ও স্বনির্ভরে এবং রাঙামাটি শহরে পাহাড়িদের ওপর সংঘটিত ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনায় জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ও অংশগ্রহণে একটি শক্তিশালী তদন্ত কমিটি গঠন করে হামলার সুষ্ঠু তদন্তপূর্বক দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানসহ ৫দফা দাবি জানিয়েছেন দীঘিনালা-খাগড়াছড়ি-রাঙামাটি সেনা-সেটলার হামলায় নিহতদের পরিবার, আহত ও প্রতক্ষ্যদর্শীরা।
আজ রবিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের তয় তলায় মাওলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁ হল রুমে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলন থেকে তারা এই দাবি জানান।
সংবাদ সম্মেলনে কান্না বিজড়িত চোখের পানি মুছতে মুছতে খাগড়াছড়ির স্বনির্ভরে সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত শিক্ষার্থী জুনান চাকমার মা রূপসা চাকমা নিজ মাতৃভাষায় (চাকমা) বলেন, “আগে আমি বাংলাদেশ সেনাবাহিনকে সম্মান করতাম, এখন আমি আর করি না; কারণ তারা খুনি, ছাত্র হত্যা করে। সেনাবাহিনী সদস্যরা আমার ছেলেকে গুলি করে হত্যা করেছে। সেদিন সেনাবাহিনীর সদস্যরা গুলি চালিয়ে ক্ষান্ত হয়নি জুনানকে বন্দুকের বাট দিয়ে নির্মমভাবে আঘাত করেছিল। আমি আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই। স্বনির্ভর, দীঘিনালা ও রাঙামাটি হামলার ঘটনা যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে এবং আমার মত কোন মায়ের বুক যেন খালি না হয় সেজন্য জাতিসংঘে তত্ত্বাবধানে একটি শক্তিশালী তদন্ত টিম গঠন করে হামলার ঘটনা সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানাচ্ছি।
“জুনানের হত্যার বিচার হলে এবং খুনি সেনা সদস্যদের শাস্তি নিশ্চিত হলে আমি মরে গেলেও আমার আত্মা শান্তি পাবো” বলেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, “আমি এখনো ভয় ও আতঙ্কে আছি। জুনানকে হারানোর পর তার ছোট ভাইকে স্কুলে ও বাইরে কোথাও পাঠাতে ভয় হচ্ছে। কখন, কোন মূহর্তে কি হবে, সেনা-সেটলারা আরো কোন হামলা করবে কিনা এই আশঙ্কায় দিন কাটছে আমার।”
সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত রুবেল ত্রিপুরা মা নিরন্তা ত্রিপুরা নিজ ভাষায় (ককবরক) বলেন, “রুবেল সম্পূর্ণ নির্দোষ ছিল, তিনি কোন রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত ছিল না। তিনি রাজমিস্ত্রি কাজ করে আমাদের পরিবারকে দেখভাল করতেন, পরিবারে একমাত্র উপার্জনকারীকে সেনাবাহিনী নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করেছে।”
তিনি আরো বলেন, ‘দীঘিনালায় হামলার ঘটনার পর রুবেল নিজ এলাকার দোকানপাট, গ্রাম নিরাপত্তার জন্য বাড়ি থেকে বের হয়। তিনি বলেছিলেন, রক্ত দিয়ে হলেও সেটলারদের হাত থেকে এলাকার বাড়িঘর-দোকানপাট অগ্নিসংযোগ থেকে রক্ষা করবে, রুবেল তাই করেছিল। আর্মিরা তাকে গুলি করে হত্যা করেছে।’
তিনি বলেন, আমার ছেলে রুবেল ত্রিপুরার আগামীকাল শ্রাদ্ধক্রিয়া হবে। আমার ছেলে হত্যার বিচার চাওয়ার জন্য আমি আজকে আপনাদের মাঝে এখানে উপস্থিত হয়েছি। আমি সেনা-পুলিশের কথা মানবো না। যারা রুবেলকে হত্যা করেছে তাদের বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।
দীঘিনালায় নিহত ধনরঞ্জন চাকমার ছেলে বিনক চাকমা বলেন, ‘দীঘিনালা লারমা স্কোয়ারে সেটলাররা পাহাড়িদের দোকানপাটে আগুন জ¦ালিয়ে দেয়ার খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে তখন আমার বাবাসহ আশেপাশে এলাকার জনগণ তা রক্ষা করার জন্য এগিয়ে যায়। আগ্নিসংযোগের সময় সেনাবাহিনী সদস্যরা হামলাকারী সেটলারদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা না করে পাহাড়িদের ওপর হামলা, লাঠিচার্জ ও ফাঁকা গুলি করে। সে সময় সেনাবাহিনী সদস্যরা আমার বাবাকে তুলে নিয়ে যায়, বন্দুকে বাট দিয়ে আঘাত করে এবং হাত-পায়ের রগ কেটে দেয় ও নির্মমভাবে হত্যা করে। এখনো আমরা ভয় ও আতঙ্কে আছি।’
তিনি আরো অভিযোগ করে বলেন, “নিরাপত্তার জন্য সেনাবাহিনীকে পার্বত্য চট্টগ্রামে নেয়া হয়েছে। কিন্তু সেনাবাহিনী আমাদের রক্ষা না করে, নিরাপত্তা না দিয়ে হত্যা করছে, গুলি চালাচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী প্রয়োজন নেই, আমরা সেনা শাসন থেকে মুক্তি চাই এবং অবিলম্বে পাহাড়ে সেনা শাসন প্রত্যাহার করা হোক। আমি আমার বাবার হত্যাকারীদের বিচারে দাবি জানাচ্ছি।”
লিখিত বক্তব্য তারা বলেন, খাগড়াছড়ি-দীঘিনালা ও রাঙামাটিতে সেনা-সেটলার কর্তৃক ৪৮ ঘন্টা ধরে চলা এই বর্বরোচিত হামলায় চার জন নিহত ও শতাধিক আহত হন, যারা সবাই পাহাড়ি। সংজ্ঞাহীন গুরুতর আহত দু’জন চট্টগ্রামে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। দীঘিনালায় ১০৫টি দোকান ও রাঙামাটিতে ছোট-বড় অন্তত ১০০টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হামলাকারী সেটলার বাঙালিরা রাঙামাটিতে পার্বত্য চটগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের অফিসেও হামলা চালায় এবং সেখানে গ্যারেজে রাখা ৯টি গাড়ি ও একটি মোটর সাইকেল পুড়িয়ে দেয়।এছাড়া সেটলাররা বৌদ্ধ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান মৈত্রী বিহারে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। হামলা শেষ হওয়ার পরই কেবল প্রশাসন রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে ১৪৪ ধারা জারি করে।
ঘটনার পরদিন ২১ সেপ্টেম্বর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তিন উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ (স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়), লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (স্বরাষ্ট্র) ও সুপ্রদীপ চাকমা (পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক) রাঙামাটি সফর করেন। অন্যদিকে তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম দীঘিনালায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেন এবং স্থানীয় জনগণ ও ক্ষতিগ্রস্তদের সাথে মত বিনিময় করেন। গত বৃহস্পতিবার সরকার ৭ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিট গঠন করলেও, হামলা, খুন ও লুটপাটের সাথে জড়িত কাউকে এখনও পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয়নি। অন্যদিকে পাহাড়িদের মধ্যে এখনও ভয় ও আতঙ্ক কাটেনি; হামলার ঘটনা সোশ্যাল মিডিয়ায় যারা লাইভ করেছিলেন তাদের পুলিশ গ্রেফতারের জন্য খোঁজ করছে বলে জানা গেছে।
লিখিত বক্তব্য আরো উল্লেখ করেন, জুলাই-আগষ্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতন হলে, আমরা পাহাড়ি জনগণও নতুন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে আত্মমর্যাদাসহ শান্তিপূর্ণভাবে বসবাসের স্বপ্ন দেখেছিলাম। বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশে স্বাধীনতার স্বাদ নিতে উদগ্রীব ছিলাম। কিন্তু আজ এ হামলার পর আমাদের স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে চলেছে। সরকার ঘটনা তদন্তের জন্য ৭ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে, কিন্তু এ কমিটির ওপর আমাদের কোন আস্থা নেই। এছাড়াও লিখিত বক্তব্য খাগড়াছড়ি স্বনির্ভর, দীঘিনালা ও রাঙামাটির হামলার ঘটনার বিবরণ তুলে ধরা হয়।
সংবাদ সম্মেলন থেকে তারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে ৫ দফা দাবি জানান। দাবিগুলো হলো:
১. জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ও অংশগ্রহণে একটি শক্তিশালী তদন্ত কমিটি গঠন করে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা ও স্বনির্ভর এলাকায় এবং রাঙামাটিতে পাহাড়িদের ওপর সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও হামলার তদন্ত করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
২. জানমালের ক্ষয়ক্ষতি নির্ণয়পূর্বক উক্ত তদন্ত কমিটির সুপারিশ ও নির্দেশনা মোতাবেক নিহত-আহতদের পরিবার, ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকদের পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
৩. অতিদ্রুত বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসারত আহতদের সুচিকিৎসা প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে।
৪. হাসিনা সরকারের পদায়িত সাম্প্রদায়িক সহিংসতার সঙ্গে জড়িত সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের বরখাস্ত এবং প্রচলিত ও সেনা আইনে বিচার করতে হবে।
৫. পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ও স্থিতিশীলতা আনয়নের লক্ষ্যে রাজনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে এবং সেনাশাসন ও সেটলারদের প্রত্যাহার করতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন, রাঙামাটি হামলায় আহত ও প্রতক্ষ্যদর্শী খুকুমণি চাকমা। এসময় উপস্থিত ছিলেন খাগড়াছড়ি স্বনির্ভরে সেনাবাহিনী গুলিতে নিহত জুনান চাকমার মা রূপসা চাকমা ও নিহত রুবেল ত্রিপুরার মা নিরন্তা ত্রিপুরা, দীঘিনালায় সেনাবাহিনী হামলায় নিহত ধনরঞ্জন চাকমার ছেলে বিনক চাকমা, খাগড়াছড়ি সদর সেনা হামলায় আহত উত্থান চাকমা, কিরন চাকমা, বিপুল চাকমা, বাবুমনি চাকমা, দীঘিনালায় সেনা-সেটলার হামলার ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী মঙ্গল সেন চাকমা, যাদু মনি চাকমা ও রাঙামাটির হামলা প্রত্যক্ষদর্শী ঝুমকা রানী চাকমা, রুমেল চাকমা।
এছাড়াও সংবাদ সম্মেলনে একাত্মতা প্রকাশ করে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলে সম্পাদক ফয়জুল হাকিম, ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, নিউএজ পত্রিকার সাংবাদিক ও গবেষক সাদিয়া গুলরুখ প্রমুখ।
সংবাদ সম্মেলন আগে প্রজেক্টরে মাধ্যমে সেনা-সেটলার কর্তৃক দীঘিনালা-স্বনির্ভর ও রাঙামাটিতে পাহাড়িদের ওপর হামলার ঘটনা ভিডিও চিত্র প্রদর্শন করা হয়।