নিজস্ব প্রতিনিধিঃ নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করি, শক্তিশালী নারী আন্দোলন গড়ে তুলি-এই শ্লোগান নিয়ে আজ ২৬ এপ্রিল’২৪ সকাল ১০:০০ টায় দুইদিনব্যাপী আয়োজিত বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের জাতীয় পরিষদ সভা-২০২৪ এর উদ্বোধনী অধিবেশন ঢাকাস্থ শেখ হাসিনা পার্বত্য চট্টগ্রাম কমপ্লেক্সের মাল্টিপারপাস অডিটোরিয়ামে শুরু হয়। সংগঠনের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উদ্বোধনী অধিবেশনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাননীয় প্রতিমন্ত্রী সিমিন হোসেন (রিমি), এমপি। বিশেষ অতিথি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন এন্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. তানিয়া হক এবং অ্যাম্বাসী অব সুইডেনের সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার (গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসন এবং লিঙ্গ সমতা উন্নয়ন সহযোগিতা বিভাগ) রেহানা খান। স্বাগত বক্তব্য রাখেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের শুরুতে জাতীয় পতাকা ও সংগঠনের পতাকা উত্তোলন করা হয়। এ সময় জাতীয় সংগীত পরিবেশন করেন উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর নৃত্য ও সঙ্গীত বিষয়ক সম্পাদক সুরাইয়া পারভীন এবং তার দল। উদ্বোধনী অধিবেশন সংগীত পরিবেশন করেন বিশিষ্ট রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সুস্মিতা আহমেদ ও শারমিন সাথী ময়না। সভায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক শোক প্রস্তাব পাঠ করেন সংগঠনের সহ-সভাপতি রেখা চৌধুরী। এসময় প্রয়াত সকল বিশিষ্টজনের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ১ মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। প্রাক্তন সভাপতি হেনা দাসের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন করেন সংগঠনের সহ-সভাপতি ডা. মাখদুমা নার্গিস।
উক্ত জাতীয় পরিষদ সভায় সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতৃবৃন্দসহ ৫৫টি জেলা শাখার প্রায় ৩০০ জন কাউন্সিলরসহ প্রায় ৫০০ জন অংশগ্রহণ করেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাননীয় প্রতিমন্ত্রী সিমিন হোসেন (রিমি), এমপি বলেন, নারীর প্রতি সহিংসতা নির্মূল করে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে, মুক্তিযুদ্ধের আলোকে দেশপ্রেমকে সমুন্নত রাখতে সকলের নিজ নিজ জায়গা থেকে কাজ করা দরকার। আজকের সময়ে নারীর প্রতি সহিংসতা ও যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটছে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ^বিদ্যালয় পর্যন্ত। এই জায়গায় মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করে কাজ করে যেতে হবে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও প্রযুক্তিগত দক্ষতার বিস্তৃত ক্ষেত্রের মধ্যে মানুষের মানবিক মূল্যবোধ, বিবেকবোধের জায়গা সমুন্নত রাখতে তৎপর হতে হবে। জাতীয় ও বৈশি^ক প্রেক্ষাপটে মানবিক উন্নয়নের উপর গুরুত্ব দিতে হবে। তিনি আরো বলেন মানবিকতা বোধের চর্চার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রয়াত ও বর্তমান নেত্রীবৃন্দ সবসময় সুস্থির থেকে পরিমিতি বোধের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। বর্তমানের অস্থির সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতিতে তিনি এসময় উপস্থিত কাউন্সিলরদের প্রতি সুস্থির থাকার আহ্বান জানান। তিনি আরো বলেন স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে জ্ঞান নির্ভর ইতিবাচক দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলা, নারীর প্রতি সহিংসতার প্রতিরোধে প্রচলিত আইনের সঠিক প্রয়োগ করতে হবে, বিচারহীনতার সংস্কৃতি দূর করতে হবে, গবেষণার ক্ষেত্র বিস্তৃত করার উপর জোর দিতে হবে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের উইমেন এন্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. তানিয়া হক বলেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ বরাবরই অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে আসছে। তথ্য প্রযুক্তিতে নারীকে অর্ন্তভূক্ত করা হচ্ছে। ডিজিটাল প্রযুক্তির বাইরে নারীর অবস্থান, নারীর অংশগ্রহণ আরো ব্যাপক হয়েছে। নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে নারীর প্রতি থাকা বৈষম্য দূর করে বিনিয়োগের উপর তিনি এ সময় গুরুত্বারোপ করে বলেন এই বিনিয়োগ শুধু জেন্ডার বাজেটের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সমাজে নারীর অসম অবস্থানকে চিহ্নিত করে তা উত্তরণের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, মানবিক শিক্ষার জন্য বিনিয়োগ করতে হবে।
অ্যাম্বাসী অব সুইডেনের সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার রেহানা খান বলেন, জেন্ডার সমতা অর্জন ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ৫নং লক্ষ্য অর্জন সুইডেন সরকারের অন্যতম লক্ষ্য। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাতক্ষীরা জেলা শাখায় ফিল্ড ভিজিট এর অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেখানে নারীরা জলবায়ু চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলায় সাহসী ও উদ্যোগী ভূমিকা রাখছে। নারীর প্রতি শূন্য সহিংসতা নীতি বাস্তবায়নে মহিলা পরিষদের জেলা শাখার উদ্যোগে গৃহীত কর্মসূচিগুলো একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। আজকের কর্মসূচির মাধ্যমে শুধুমাত্র নারীর অর্জনকে সামনে না এনে চ্যালেঞ্জসমূহ কি রয়েছে তার প্রতি মনোযোগ দেয়া দরকার।
সভাপতির বক্তব্যে সংগঠনের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন,
নারী হওয়ার জন্য সুনির্দিষ্ট বৈষম্য আছে পরিবারে, সমাজে,আইনী কাঠামোতে। আইনী কাঠামোর দূর্বলতা, পারিবারিক দূর্বলতা, সামাজিক চিন্তা-চেতনার পশ্চাৎপদতা এবং ধর্মান্ধতা নারীর প্রতি সহিংসতাকে জিইয়ে রেখেছে। নারীর প্রতি এই বৈষম্য দূর করতে সংগঠনকে অর্ন্তভূক্তিমূলক আন্তপ্রজন্মগত নেতৃত্ব গড়ে তোলার উপর জোর দিতে হবে; সংগঠনের সাথে নতুন প্রজন্মকে যুক্ত করতে হবে এবং বৈচিত্র্যকে ধারণ করতে হবে। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে সরকারি কমিটিগুলোকে বেসরকারি নারী সংগঠনের সাথে যৌথভাবে কাজ করতে হবে; সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের সমন্বয় করতে হবে। নারীর অধিকার সংরক্ষণের বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে বৈশি^ক নারী আন্দোলনের সাথে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদকে ঐক্যবদ্ধ থেকে বহমান কর্মসূচির ধারা অব্যাহত রাখার উপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
স্বাগত বক্তব্যে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যে মালেকা বানু বলেন, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের জেন্ডার গ্যাপ ২০২৩ এর রিপোর্ট অনুযায়ী বৈশি^ক প্রেক্ষাপটে জেন্ডার সমতার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে এখনো অনেক দেশ নারী-পুরুষের বৈষম্য কমিয়ে আনতে পারেনি। বাংলাদেশ সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে দীর্ঘদিন নারীর প্রতিনিধিত্ব থাকার ফলে রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের অবস্থান অনেক উপরে হলেও সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর অবস্থান এখনও পিছিয়ে। এমন পরিস্থিতিতে নারী আন্দোলনের দীর্ঘদিনের অ্যাডভোকেসির ফলে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যে সফলতা এসেছে তার চেয়ে বেশি পিছিয়ে নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে। পরিস্থিতির পরিবর্তন করতে উগ্রবাদ, মৌলবাদ, ধর্মান্ধতা থেকে নিজেকে ও সমাজকে মুক্ত করে প্রযুক্তির ব্যবহরে সক্ষমতা অর্জন, বাস্তব জগতে নিজেদের দৃঢ় অবস্থান তৈরি করে নারী আন্দোলনকে নতুন শতাব্দীর জন্য উপযোগী ও বিস্তৃত করে গড়ে তোলার জন্য উপস্থিত কাউন্সিলরদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সংগঠক সম্পাদক উম্মে সালমা বেগম। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে ১ম কর্ম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। অধিবেশনে সাংগঠনিক শোক প্রস্তাব পাঠ করেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি লক্ষী চক্রবর্তী। কেন্দ্রীয় কমিটির কার্য বিবরণী পেশ করেন সংগঠনের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. মাসুদা রেহানা বেগম; সাধারণ সম্পাদকের সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু; কেন্দ্রীয় কমিটি আয় ব্যয়ের হিসাব উপস্থাপন করেন অর্থ সম্পাদক দিল আফরোজ বেগম। সভা সঞ্চালনা করেন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সাথী চৌধুরী।
১ম কর্ম অধিবেশন শেষে ২য় ও ৩য় কর্ম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। ২য় অধিবেশনে নারীর প্রতি বৈষম্য: সম্পদ সম্পত্তিতে নারীর সমান অধিকার, নারীর প্রতি বৈষম্য:সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীর অংশগ্রহণ; নারীর প্রতি বৈষম্য:জাতীয় শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ; নারীর প্রতি বৈষম্য ও সহিংসতা: সাম্প্রদায়িকতা ও গৎবাধা সামাজিক প্রথা এবং শক্তিশালী নারী আন্দোলন: অর্ন্তভূক্তিমূলক সংগঠন-এর উপর আলোচনা ও দলীয় কাজ অনুষ্ঠিত হয়। দলীয়কাজে কেন্দ্রীয় ও জেলার শাখার কাউন্সিলরবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন।