রুপসীবাংলা৭১ অন্যান্য ডেস্ক : প্রায় হাজার বছর আগে গাজীপুরের টঙ্গীর তৎকালীন ভরান রাজ্যের রূপসী রাজকন্যা বীর নারী সোনাবানের কথা আমরা কেউ কেউ হয়তো শুনে থাকব। এ নিয়ে বাংলা সাহিত্যে নানা উপাখ্যান ও পুঁথি রয়েছে। তা ছাড়া একজন গ্রামীণ নারীর বিমূর্ত প্রতীক হিসেবে পরিচিত সোনাবান বিবির নাম আমরা প্রায়ই শুনে থাকি। যাক, সেই সোনাবান বিবির কিচ্ছা কিংবা রূপসী সোনাভানের বীরত্বগাথা নিয়ে আজ কোনো আলোচনা করা হবে না।
আজ এখানে ‘সোনাবান’ নামে একটি সামুদ্রিক মাছ নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করা হবে। এ মাছের নাম আমরা অনেকেই জানি না। আমাদের দেশের সামুদ্রিক ও উপকূলীয় জলাশয়ে নানা প্রজাতির মাছ রয়েছে। এসব মাছের বৈচিত্র্য নিয়ে ১৯৬৯ সালে দেশে প্রথম প্রথম প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
এর প্রণেতা ছিলেন বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান মোজাফফর হোসেন। এই প্রতিবেদনে তখন ১৩৩টি পরিবারভুক্ত মোট ৪৭৪ প্রজাতির মাছের নাম লিপিবদ্ধ করা হয়। কিন্তু এ প্রতিবেদনে নামের সঙ্গে মাছের কোনো ছবি সন্নিবেশিত করা হয়নি। পরে বিভিন্ন সংস্থা ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিচ্ছিন্নভাবে এ ধরনের জরিপ পরিচালনা করা হয়।
কিন্তু সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদের সুষ্ঠু ও স্থায়িত্বশীল ব্যবস্থাপনার জন্য মাছের ট্যাক্সোনমিক পরীক্ষাসহ ছবিসংবলিত একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকার অভাব দীর্ঘদিন যাবৎ দেশে অনুভূত হয়ে আসছিল। এ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) অর্থায়নে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিগরি সহযোগিতায় বঙ্গোপসাগর ও উপকূলীয় অঞ্চলের মাছের ক্যাটালগিং, ট্যাক্সোনমি, বিস্তৃতি, প্রজননকাল এবং খাদ্যাভ্যাসের ওপর প্রায় পাঁচ বছর যৌথ গবেষণা পরিচালনা করা হয়।
গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ২০২০ সালে Marine Fishes of Bangladesh শিরোনামে ইংরেজিতে একটি বই এবং ২০২৩ সালে ‘বাংলাদেশের সামুদ্রিক মাছ’ নামে বাংলায় একটি সচিত্র অ্যালবাম প্রকাশিত হয়। এ গবেষণায় আমাদের সমুদ্র ও উপকূলীয় অঞ্চলে মোট ১১০ পরিবারের ৪২৬ প্রজাতির মাছ তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে ‘সোনাবান’ একটি প্রজাতি।
কক্সবাজার অঞ্চলে এটি স্থানীয় নাম। এর ইংরেজি নাম হচ্ছে Teardrop threadfin bream. Pieter Bleeker নামে একজন ডাচ বিজ্ঞানী এই মাছটি প্রথম আবিষ্কার করেন এবং ১৮৭৩ সালে এর নামকরণ করা হয় Dentex isacanthus। পরে এর বৈজ্ঞানিক নাম পরিবর্তন করে Nemipterus isacanthus (Bloch, 1791) রাখা হয়। সোনাবান Nemipteridae পরিবারের রশ্মি-পাখনাযুক্ত একটি মাছ। এই পরিবারের অধিকাংশ প্রজাতিই মাংশাসী স্বভাবের, অল্প কয়েকটি প্ল্যাংকটনভোজী। আমাদের জলাশয়ে এই পরিবারের ‘রূপবান’ (Nemipterus japonicas), ‘কৃষ্ণকলি’ (Scolopsis igcarensis) ও ‘সুন্দরী কমলা’ (Scolopsis vosmari) নামে আরো তিনটি প্রজাতি রয়েছে। পরে এই তিনটি প্রজাতি নিয়ে ভিন্ন পরিসরে আলোচনা করা যাবে। আজ শুধু সোনাবান মাছ নিয়েই সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হবে। ইন্দো-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলসহ উত্তর অস্ট্রেলিয়ায় সোনাবান মাছের বিস্তৃতি রয়েছে। সোনাবান প্রজাতির মাছ লম্বায় সাধারণত ১৫ থেকে ১৮ সেন্টিমিটার হয়; সর্বোচ্চ আকার হয় ২২ সেন্টিমিটার। ওজনে সাধারণত ১০০ থেকে ১৫০ গ্রাম এবং সর্বোচ্চ ২০০ গ্রাম হয়। সোনাবান মাছের মুখ লম্বা, চোখ মাথার ওপরের দিকে অবস্থিত, দেহ উপবৃত্তাকার ও সামান্য সংকুচিত। দেহের উপরিভাগে গোলাপি আভা এবং নিচের দিকে রুপালি সাদা রং হয়। চোখের আইরিশ লাল। পৃষ্ঠীয় পাখনায় ১০টি কাঁটা ও ৯টি নরম রশ্মি আছে এবং বক্ষ পাখনা লম্বা। জলাশয়ে এদের বসবাস উপযোগী তাপমাত্রা হচ্ছে ২০ থেকে ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এরা সমুদ্র উপকূলে ৫০ মিটারের বেশি (সর্বোচ্চ ২০০ মিটার) গভীরতায় কাদা বা বালিময় তলদেশে বসবাস করতে পছন্দ করে।
বর্ষাকালে এরা কম গভীর পানিতে চলে আসে। ছোট ছোট মাছ, চিংড়ি, কেঁচো ও কৃমি জাতীয় খাবার খেয়ে এরা জীবন ধারণ করে। চিংড়ি ধরার ট্রল নেট এবং গিল নেটে এসব মাছ বাই-ক্যাচ হিসেবে ধরা পড়ে। এ মাছের বাজারমূল্য তুলনামূলকভাবে কম। দেহের আকারের তুলনায় সোনাবান মাছের ডিম ধারণক্ষমতা অপেক্ষাকৃত বেশি এবং প্রজননকাল মে থেকে আগস্ট পর্যন্ত। একই বয়সের স্ত্রী মাছের চেয়ে অপেক্ষাকৃত ছোট পুরুষ মাছ আগেই প্রজননক্ষম হয়।
সোনাবান মাছ শীতকালে খেতে বেশি সুস্বাদু। চীনের জুয়াংজু অঞ্চলে শীতকালে মুরগির তেলে (মুরগির চামড়া থেকে আহরিত) এই মাছ দিয়ে এক ধরনের বিশেষ খাবার তৈরি করা হয়, যা খুবই জনপ্রিয়। আইইউসিএনের (IUCN) তথ্য মতে, এ মাছের উৎপাদন ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে।
লেখক : মৎস্য বিশেষজ্ঞ
রুপসীবাংলা৭১/এআর

