রুপসীবাংলা৭১ অন্যান্য ডেস্ক : সকাল আটটা। ফার্মগেট মোড়ে মানুষের ভিড় জমে উঠেছে। কর্মজীবী নারী-পুরুষ, শিক্ষার্থী, পথচারী সবাই ছুটছেন যার যার গন্তব্যে। এই ব্যস্ততার মধ্যেও অনেকের মনে প্রশ্ন প্রয়োজনে ব্যবহার করার মতো একটা পরিষ্কার ও নিরাপদ পাবলিক টয়লেট কোথায় পাওয়া যাবে? কিছু বছর আগেও এই প্রশ্নের উত্তর বেশ জটিল ছিল।
কিন্তু হালআমলে রাজধানী ঢাকা ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ও জনবহুল এলাকায় এখন গড়ে উঠেছে আধুনিক ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত বেশ কিছু পাবলিক টয়লেট, যেগুলো শুধুই গণশৌচাগার নয় নগরবাসীর মর্যাদা ও নিরাপত্তার প্রতীক হয়ে উঠছে। এই টয়লেটগুলো আলাদা নজর কাড়ে এর গঠনশৈলী আর ব্যবস্থাপনার জন্য। প্রতিটি স্থাপনায় রয়েছে নারীদের জন্য নিরাপদ ও স্বস্তিদায়ক ব্যাবস্থা, স্যানিটারি ন্যাপকিন মেশিন ও নিষ্পত্তির ব্যবস্থা, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের উপযোগী প্রবেশপথ, হাত ধোয়ার ও পানি পান করার সুবিধা, এমনকি গোসল করার ব্যবস্থাও। আর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা? দিনের একাধিকবার নিয়মিত তদারকি নিশ্চিত করা হয়।
কিম্বার্লি-ক্লার্ক ও এইচএন্ডএম ফাউন্ডেশনের সহায়তায় ওয়াটারএইড বাংলাদেশ এই টয়লেটগুলো শুধু নির্মাণ করেই ক্ষান্ত দেয়নি, বরং বছরের পর বছর ধরে টানা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, ব্যবহারযোগ্যতা ও নিরাপত্তার মান বজায় রেখে তা আজ ব্যবহারকারীদের আস্থার জায়গায় পরিণত করেছে। বর্তমানে ঢাকায় ২০টি, চট্টগ্রামে ৮টি এবং রাজশাহী, ঈশ্বরদী ও পঞ্চগড়েও একাধিক টয়লেট নিয়মিত সচল রয়েছে। গ্রাহকেদের আরও উন্নত পরিসেবা দিতে ওয়াটারএইড বাংলাদেশ চালু করেছে ‘পথের দাবি’ শীর্ষক এক বিশেষ সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন, যার আওতায় নতুন রূপে সেজেছে ঢাকার ২০টি পাবলিক টয়লেট। টয়লেটগুলো এখন আরও সেবাধর্মী ও আরও নারীবান্ধব।
ফার্মগেটের ভাসমান কাঁচাবাজারে সবজি বিক্রি করেন কাওসার আলী। তিনি জানান, “আগে উল্টো পাশের পার্কে কাম সারতাম। লজ্জা লাগত, কিন্তু কিছু করার ছিল না। এখন ইন্দিরা রোডের সামনের টয়লেটে যাই। আর এখন তো গরমকাল, গরম সহ্য করতে না পারলে সেখানে গিয়ে বেচাকেনার টাকা লকারে রেখে গোসলও করে আসি।
টাকা লাগলেও ভালো, আরাম আছে”।
শুধু কাওসার নন, দৈনিক শত শত নারী, পথচারী, নিম্ন আয়ের কর্মজীবী, দোকান কর্মচারী, শিক্ষার্থী এসব টয়লেট ব্যবহার করছেন স্বাচ্ছন্দ্যে। মিরপুর-১২ নম্বরের পাবলিক টয়লেটের নিয়মিত ব্যাবহারকারী গার্মেন্টস শ্রমিক রুনা আক্তার জানালেন, “আগে বাইরে বের হলেই পানি খাওয়া কমিয়ে দিতাম। ভালো তো দূরের কথা, ন্যূনতম ব্যবহার উপযোগী টয়লেট তো কোথাও ছিল না। এখন এখানে এসে নিশ্চিন্তে টয়লেট করতে পারি। পরিষ্কার, নিরাপদ ও ভেতরে সব কিছু আছে। এটা একটা বড় স্বস্তি।” আবার চট্টগ্রামের অক্সিজেন মোড় এলাকার এক শিক্ষার্থী সুমাইয়া বিনতে আলী বলেন, “মেয়েদের কথা মাথায় রেখে এমন পাবলিক টয়লেট হবে কল্পনাও করিনি। এখানে সবকিছু আছে ভেতরে আলাদা ব্যবস্থা, স্যানিটারি ন্যাপকিন ফেলার জায়গা, জরুরি প্রয়োজনে ন্যাপকিন কেনা, আয়না, সাবান, নিরাপত্তা সব ঠিকঠাক।”
আর এই সুবিধাগুলোর প্রচারে সম্প্রতি ওয়াটারএইড বাংলাদেশ শুরু করেছে ‘পথের দাবি’ নামের একটি সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন। এর মূল উদ্দেশ্য মানুষকে সচেতন করা, পাবলিক টয়লেট ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করা এবং নগর ব্যবস্থাপনায় এই ধরনের টয়লেটের গুরুত্ব তুলে ধরা। পাশাপাশি, ক্যাম্পেইনের আওতায় পাবলিক টয়লেটগুলো সেজেছে নতুন রূপে। এগুলো এখন আরও বেশি নারীবান্ধব ও সেবাধর্মী হয়ে উঠেছে।
সচেতন নাগরিকেরা বলছেন, পাবলিক টয়লেট নিয়ে লজ্জা বা দ্বিধা নয় এটা নিয়ে কথা বলা উচিত। কারণ এটি স্বাস্থ্য, সম্মান ও সমান সুযোগের সঙ্গে জড়িত। ‘পথের দাবি’ ক্যাম্পেইনটি সেই কথা সাহসের সঙ্গে বলছে। ওয়াটারএইড বাংলাদেশের কমিউনিকেশনস কোঅর্ডিনেটর প্লাবন গঙ্গোপাধ্যায় জানান, “এই টয়লেটগুলো শুধু ভৌত পরিকাঠামো নয়, এটি নাগরিকদের অধিকার নিশ্চিত করার ও নগরকে স্বাস্থ্যকর করার একটি প্রয়াস। ইমারত শহরের মুখশ্রী হলেও সেটি কতটুকু সর্বস্তরের জনমানসকে ধারণ করে তা দেখার আয়না হলো জনপরিসরে হাইজিন ও স্যানিটেশনের চর্চা। এক্ষেত্রে শুধু অবকাঠামো নির্মাণ নয়, বরং ব্যবস্থাপনা, পরিচ্ছন্নতা, নারীদের চাহিদা এবং ইতিবাচক নাগরিক আচরণ—সব কিছুর সমন্বয় জরুরি। আমরা দেখিয়েছি, এই ধরনের মডেলেও পাবলিক টয়লেট কার্যকরভাবে পরিচালনা করা সম্ভব। এখন দরকার এ ধরনের উদ্যোগকে আরও বিস্তৃত করা।”
এই মুহূর্তে দেশে পাবলিক টয়লেটের যে ঘাটতি রয়েছে, তা পূরণে সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারিত্বে এমন মডেল আরও বিস্তৃত করা গেলে, শহরবাসীর দীর্ঘদিনের ভোগান্তির অবসান ঘটবে। আর নারীদের জন্য নিরাপদ ও সম্মানজনক চলাফেরা নিশ্চিত করতে এটাই হতে পারে বাস্তবসম্মত এক ‘পথের দাবি’।
বাগেরহাট থেকে ঢাকায় সন্তানের বাসায় বেড়াতে এসেছিলেন ৬৯ বছর বয়সী জসীমুদ্দিন হাওলাদার। ডায়াবেটিকসে ভোগা জসীমুদ্দিন গাবতলী বাস টার্মিনালের পাবলিক টয়লেটটি প্রথমবারের ব্যবহার করেন। তিনি জানান, “এই জায়গায় এত লোকজন, এত যানজট একটু কোথাও বসার জায়গা মেলে না, আর টয়লেট তো দূরের কথা। আমাকে ঘণ ঘণ টয়লেটে যেতে হয়। বাইরে বের হলেই চিন্তা হয় টয়লেট পাবো তো? কিন্তু এখানকার টয়লেটটা দেখে ভালোই লাগল। ভেতরটা পরিষ্কার, পানির ব্যবস্থা আছে, আর কেয়ারটেকারও সহায়তা করে। এরপরে ঢাকা আসা যাওয়ার সময় টেনশন একটু কম হবে।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে নগরায়নের দ্রুতগতি এবং শহরাঞ্চলে শ্রমজীবী মানুষের বহুগুণে বেড়ে যাওয়া ও দৈনন্দিন প্রয়োজনে চলাচলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নগরে পর্যাপ্ত পাবলিক টয়লেট থাকা অত্যন্ত জরুরি। অন্যথায় স্বাস্থ্যঝুঁকি, পানির ঘাটতি ও নারীদের চলাফেরার সুযোগ সব কিছুতেই বাধা তৈরি হবে। তাই, ব্যস্ত নগরের নাগরিক মর্যাদা পূরণে পাবলিক টয়লেটের যে দৃষ্টান্ত দুঃস্থ স্বাস্থ্য কেন্দ্র (ডিএসকে) ও সামাজিক উদ্যোগ ‘ভূমিজ’র পরিচালনায় ওয়াটারএইড তৈরি করেছে তা বাংলাদেশের বড় বড় শহরে ছড়িয়ে দেওয়া এখন নতুন বাংলাদেশের পথের দাবি।
রুপসীবাংলা৭১/এআর