রুপসীবাংলা৭১ অন্যান্য ডেস্ক : মানব সমাজে যুগে যুগে কিছু নেতিবাচক মানসিকতা মানুষকে ভ্রান্ত পথে পরিচালিত করেছে। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে গুজব, কুসংস্কার ও অজ্ঞতা। এই তিনটি সামাজিক ব্যাধি মানুষের চিন্তা-চেতনা, জীবনযাত্রা ও বিশ্বাসকে প্রভাবিত করে, কখনো সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে এবং কখনো মানুষকে শিরক, বিদআত ও কুফরির দিকে ধাবিত করে। ইসলাম, যেটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, এই গুজব, কুসংস্কার ও অজ্ঞতাকে কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং যুক্তি, প্রমাণ ও ঈমানভিত্তিক জ্ঞানচর্চার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে
গুজব হলো মিথ্যা বা ভিত্তিহীন সংবাদ, যা মানুষ না জেনে-না বুঝে প্রচার করে। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
اِذۡ تَلَقَّوۡنَهٗ بِاَلۡسِنَتِكُمۡ وَ تَقُوۡلُوۡنَ بِاَفۡوَاهِكُمۡ مَّا لَیۡسَ لَكُمۡ بِهٖ عِلۡمٌ
‘তোমরা তোমাদের জিহ্বা দিয়ে তা গ্রহণ করছিলে এবং তোমরা এমন কথা বলছিলে, যার কোনো জ্ঞান তোমাদের ছিল না।’
(সুরা : নুর, আয়াত : ১৫)
কুসংস্কার হলো বুদ্ধিবৃত্তিক ও শরিয়তবিরোধী অন্ধ বিশ্বাস। যেমন—‘নজর লেগে গেলেই দুর্ঘটনা হবে’, ‘কাক ডাকা মানেই অমঙ্গল’, ‘কালো বিড়াল পথ পার হলে বিপদ আসবে’, ‘গণক/ফকির হাত দেখে ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারে’—এসবই কুসংস্কার।
ইসলামে কুসংস্কার নিষিদ্ধ। হাদিসে এসেছে,
لاَ عَدْو‘ى وَلاَ طِيَرَةَ وَلاَ هَامَةَ وَلاَ صَفَرَ
‘সংক্রমণ (অর্থাৎ নিজের ইচ্ছায় ছড়ানো), অশুভ লক্ষণ, অলৌকিক পাখি ও নির্দিষ্ট মাসের অমঙ্গল—এসবের কোনো ভিত্তি নেই।’
(সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫৭০৭)
অর্থাৎ কাকডাকা অমঙ্গলের লক্ষণ, নববর্ষে না খেলে সারা বছর কষ্টে কাটবে, ‘ফল খারাপ আসবে’, ‘দৈব সংকেত পেলাম’—এসব ভ্রান্ত বিশ্বাস ইসলামে নেই। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি অশুভ লক্ষণের কারণে কোনো কাজ থেকে বিরত থাকে, সে শিরক করল।’
(মুসনাদ আহমাদ, হাদিস : ৯৭৫২)
তাই গৃহে বা সমাজে প্রচলিত কুসংস্কারগুলো বর্জন করে ঈমানি বিশ্বাসে দৃঢ় থাকতে হবে। ইসলামে জ্ঞানকে আল্লাহর দান এবং অজ্ঞতাকে ধ্বংসের কারণ বলা হয়েছে। কোরআনে বলা হয়েছে,
قُلۡ هَلۡ یَسۡتَوِی الَّذِیۡنَ یَعۡلَمُوۡنَ وَ الَّذِیۡنَ لَا یَعۡلَمُوۡنَ ؕ
‘বলুন, যারা জানে এবং যারা জানে না, তারা কি সমান?’ (সুরা : জুমার, আয়াত : ৯)
আর রাসুল (সা.) বলেছেন,
طَلَبُ الْعِلْمِ فَرِيضَةٌ عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ
‘প্রত্যেক মুসলমানের ওপর জ্ঞান অর্জন করা ফরজ।’ (ইবনু মাজাহ, হাদিস : ২২৪)
অজ্ঞতা মানুষকে ভুল পথে পরিচালিত করে। যে সমাজে ইসলামী জ্ঞানের অভাব থাকে, সেখানে কুসংস্কার ও গুজব সহজে বিস্তার লাভ করে।
যেমন—কেউ বিশ্বাস করে ‘বৃষ্টির পানি পাথরের সঙ্গে রাখলে বাচ্চার মুখ ফর্সা হয়।’
ইমাম গাজালি (রহ.) বলেন, ‘অজ্ঞতা এমন এক অন্ধকার, যা থেকে মুক্তির একমাত্র পথ হলো ইলম।’ (ইহইয়াউ উলুমিদ্দিন)
গুজব, কুসংস্কার ও অজ্ঞতার ফলে সমাজে নানা ধরনের বিপর্যয় সংঘটিত হয়। উদাহরণস্বরূপ—১. সামাজিক বিশৃঙ্খলা, ২. নিরীহ মানুষের ওপর জুলুম, ৩. সময় ও সম্পদের অপচয়, ৪. দ্বিনের ভুল ব্যাখ্যা ছড়ানো, ৫. ঈমান ও তাওহিদে দুর্বলতা।
গুজব, কুসংস্কার, অজ্ঞতার বিষাক্ত ছোবল ও মহাসংকট থেকে মুক্তির একমাত্র পথ ইসলামের নির্ভুল ও আলোকিত দিকনির্দেশনা—
১. যাচাই ছাড়া কিছু বিশ্বাস না করা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যা-ই পাই, তা শেয়ার করা বা বিশ্বাস করা ঠিক নয়; বরং কোরআনের নির্দেশনা অনুসারে ‘ফাতাবাইয়ানু’ অর্থাৎ যাচাই করা জরুরি। যে সংবাদ বা ঘটনার সঠিক প্রমাণ নেই, তা যাচাই না করে প্রচার করা গুনাহ।
২. কোরআন ও হাদিস নির্ভর ইসলামচর্চা।
৩. জ্ঞান অর্জন ও প্রচার করা। মসজিদ, মাদরাসা, স্কুল, কলেজ ও গণমাধ্যমে ইসলামী শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে। শুধু শোনা বা লোকমুখে প্রচলিত কথায় বিশ্বাস না করে আলেমদের কাছে জিজ্ঞাসা করে জানতে হবে। আল্লাহ বলেন,
فَسۡـَٔلُوۡۤا اَهۡلَ الذِّكۡرِ اِنۡ كُنۡتُمۡ لَا تَعۡلَمُوۡنَ
‘তোমরা যদি না জানো, তাহলে জ্ঞানীদের কাছে জিজ্ঞেস করো।’
(সুরা : নাহল, আয়াত : ৪৩)
৪. সচেতন সমাজ গঠন করা। পরিবার থেকেই কুসংস্কারের প্রতিরোধ শুরু করতে হবে। পাশাপাশি আলেমদের দায়িত্ব হলো খুতবা, ওয়াজ ও দাওয়াতের মাধ্যমে মানুষকে এই অন্ধকার থেকে মুক্ত করার জন্য সচেতনতা সৃষ্টি করা।
লেখক : মুহাদ্দিস, ছারছীনা দারুস-সুন্নাত জামেয়ায়ে নেছারিয়া দ্বিনিয়া,
নেছারাবাদ, পিরোজপুর
রুপসীবাংলা৭১/এআর