নিজস্ব প্রতিনিধিঃ অরাজনৈতিক আন্দোলন হেযবুত তওহীদ কর্তৃক সরকারের নিকট দাখিলকৃত সংবিধান ও রাষ্ট্রসংস্কারের বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। বুধবার (১৫ জানুয়ারি ২০২৫) সকাল ১১টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুরুল হক হলে এ সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।সংবিধান সংস্কার কমিশন সহ বেশ কয়েকটি কমিশন চূড়ান্ত খসড়া যখন অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের নিকট জমা দিচ্ছিল ঠিক ওই সময়ই জাতীয় প্রেসক্লাবে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে হেযবুত তওহীদ।
এর আগে গত ২৪ ডিসেম্বর হেযবুত তওহীদ জাতীয় সংসদ অবস্থিত সংবিধান সংস্কার কমিশনের কার্যালয়ে একটি লিখিত প্রস্তাবনা পেশ করে। এ প্রস্তাবনায় ৪৯টি বিষয়ের ওপর বিস্তারিত সুপারিশ তুলে ধরেন হেযবুত তওহীদের মুখপাত্র মো. মশিউর রহমানের নেতৃত্বাধীন ৭ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল। বিষয়টি নিয়ে বুধবারের সংবাদ সম্মেলনে সবিস্তারে আলোকপাত করেন আন্দোলনটির নেতৃবৃন্দ।
সংবাদ সম্মেলনে রাষ্ট্রসংস্কারে হেযবুত তওহীদ স্পষ্টভাবে উল্লেখ করে, “বিপ্লবের অর্থ হলো আমূল পরিবর্তন। ছাত্র-জনতার যে বিপ্লব সংগঠন করা হয়েছে, তার সফলতা তখনই সম্ভব, যখন মৌলিক পরিবর্তন আনা হবে। যদি কোনো মৌলিক পরিবর্তন না ঘটে, তবে এই বিপ্লব ব্যর্থ হবে। হেযবুত তওহীদ প্রস্তাব করছে আল্লাহর দেওয়া জীবন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা প্রয়োজন, আর তখনই একমাত্র বিপ্লবের প্রকৃত সুফল অর্জিত হবে।”
সংবাদ সম্মেলনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন সংগঠনের মুখপাত্র ও মহিলা বিভাগের সভাপতি রুফায়দাহ পন্নী। প্রস্তাবনার বিষয়ে মূল বক্তব্য তুলে ধরেন হেযবুত তওহীদের ঢাকা ঢাকা বিভাগের সভাপতি ডা. মাহবুব আলম মাহফুজ।
বক্তব্যে ডা. মাহবুব আলম মাহফুজ বলেন, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে একটি সরকারের পতন ঘটেছে। পতনের পর যে অন্তর্র্বতীকালীন সরকার ক্ষমতায় এসেছে, তারা রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিভাগের সংস্কারে মনোযোগ দিয়েছেন। এ লক্ষ্যে সরকার বিভিন্ন বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে সংস্কার কমিশন গঠন করেছেন। কমিশনগুলো তাদের মতামত ও সংস্কার প্রস্তাব সরকারের কাছে জমা দিচ্ছে। রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কারের ক্ষেত্রে সরকার সাধারণ জনগণসহ সব রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মহল থেকে সংস্কার প্রস্তাব আহ্বান করেছেন। তাদের লক্ষ্য হলো, সবার মতামতের ভিত্তিতে এমন একটি সুশৃঙ্খল রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রবর্তন করা যেখানে কারও হাতে একচেটিয়া ক্ষমতা কুক্ষিগত থাকবে না, অর্থপাচারের কোনো সুযোগ থাকবে না এবং রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নেরও অবকাশ থাকবে না। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে সংবিধান, নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, পুলিশ বিভাগসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খাতে সংস্কারের জন্য প্রস্তাব দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। জনসাধারণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি কার্যকর ও ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, “সরকারের উদ্যোগের পরিপ্রেক্ষিতে হেযবুত তওহীদ গত ২৪ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদে সংবিধান সংস্কার কমিশনের কার্যালয়ে একটি লিখিত প্রস্তাবনা পেশ করে। এ প্রস্তাবনায় ৪৯টি বিষয়ের ওপর বিস্তারিত সুপারিশ তুলে ধরেন হেযবুত তওহীদের মুখপাত্র মো. মশিউর রহমানের নেতৃত্বাধীন ৭ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল। আমরা মনে করি, আমাদের প্রস্তাবনাগুলো জনগণ ও সরকারকে অবহিত করার জন্য গণমাধ্যমের কাছে তুলে ধরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ডা. মাহবুব আলম মাহফুজ বলেন, “আমাদের সংস্কার প্রস্তাবের ক্ষেত্রে প্রথমেই উল্লেখ করতে চাই, স্বাধীনতার ৫৩ বছর পেরিয়ে গেলেও আমাদের দেশের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, বিচার বিভাগ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, আমলাতন্ত্র, শিক্ষা বিভাগসহ অন্যান্য বিভাগ এখনো অনেকাংশে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগের কাঠামো ও ধ্যানধারণার উপর নির্ভরশীল। ঐতিহাসিক কারণে এটি অব্যাহত থাকলেও সময় ও পরিস্থিতির পরিবর্তনে এসব ব্যবস্থায় আধুনিকায়নের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। একাত্তরে স্বাধীনতার পর প্রণীত সংবিধানে ইতোমধ্যে ১৭টি সংশোধনী আনা হয়েছে। তবুও বর্তমান সংবিধানে এমন কিছু ধারা ও বিধান রয়েছে যা স্বৈরাচারী শাসনের সুযোগ তৈরি করতে পারে। তাই এ ক্ষেত্রে আরও কার্যকর সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত জরুরি। আমাদের মূল কথা হলো, শুধু কাঠামোগত বা আংশিক সংস্কার করে কোনো কার্যকর ফল পাওয়া যাবে না। বরং রাষ্ট্রব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনই অপরিহার্য। এটাই ছিল ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের প্রধান দাবি, যাকে তারা “জুলাই বিপ্লবের ঘোষণা” বা “চৎড়পষধসধঃরড়হ ড়ভ ঔঁষু জবাড়ষঁঃরড়হ” বলে অভিহিত করেছেন। আমরা জানি, বিপ্লব মানেই হলো পুরোপুরি আমূল পরিবর্তন।
“বর্তমানে কার্যকর রাষ্ট্র কাঠামো ঔপনিবেশিক যুগের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে, যেখানে মানুষের তৈরি বিধিবিধানের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালিত হচ্ছে। আমাদের সুপারিশ হলো, রাষ্ট্রের সংবিধানের ভিত্তি হতে হবে আল্লাহর প্রদত্ত বিধান। আল্লাহর দেওয়া নির্দেশনাকে ভিত্তি করেই অন্যান্য আইন ও বিধি প্রণয়ন করতে হবে। চলমান জীবনব্যবস্থার যে বিধান কোর’আনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ সেগুলো রাখা হবে।”
দ্বিতীয় প্রস্তাবনায় বিচার বিভাগে সংস্কার বিষয়ে তিনি বলেন, “বিচার বিভাগে আল্লাহর নাজিলকৃত বিধান অনুযায়ী বিচারকার্য পরিচালনা করা। এতে অপরাধী যেই হোক না কেন, তার জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। এভাবে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে, বিচারের নামে কোনো অবিচার ঘটবে না, এবং মামলার জট কমে আসবে। এছাড়া, আমাদের প্রস্তাবে প্রাচীন বাংলার প্রচলিত সালিশ ব্যবস্থাকে পুনরায় কার্যকর করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়ের অনেক বিরোধ দ্রুত ও সহজেই মীমাংসা করা সম্ভব হবে। তিন নম্বরে আমরা বলেছি, বিচার বিভাগের ক্ষেত্রে কোন ধরনের অর্থনৈতিক লেনদেন রাখা চলবে না। বাদিবিবাদী উভয়েরই মামলার খরচ রাষ্ট্র বহন করবে।
“আমাদের চতুর্থ প্রস্তাবনা অর্থনীতির ক্ষেত্রে। বর্তমানে বিদ্যমান সুদভিত্তিক পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কারণে সমাজে গভীর অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। গুটিকয়েক লোকের হাতে বিপুল পরিমাণ সম্পদ জমা হওয়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভাজন এবং সংকট তীব্র হয়েছে। এই ব্যবস্থার ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য সীমিতসংখ্যক সিন্ডিকেটের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়েছে, যা দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতির জন্য দায়ী। এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তির জন্য আমরা সুদমুক্ত অর্থনীতির প্রস্তাবনা দিয়েছি, যেখানে কোনো অবস্থাতেই সুদ থাকবে না, কারণ আল্লাহ তায়ালা এটিকে হারাম ঘোষণা করেছেন। আমরা লাভ-ক্ষতির ভিত্তিতে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনার একটি অর্থনৈতিক কাঠামোও প্রস্তাব করেছি, যা সমাজে ন্যায়সঙ্গত অর্থনৈতিক ভারসাম্য আনতে সহায়ক হবে।”
শিক্ষা ব্যবস্থা সংস্কার বিষয়ে তিনি বলেন, বর্তমানে আমাদের দেশে যে শিক্ষা ব্যবস্থা চলমান, তা ঔপনিবেশিক যুগের বস্তুবাদী এবং ভোগবাদী চিন্তাধারার ওপর প্রতিষ্ঠিত। বর্তমানে দুটি শিক্ষা ব্যবস্থা চালু আছে- একটি মাদ্রাসা শিক্ষা এবং অন্যটি সাধারণ শিক্ষা। মাদ্রাসা শিক্ষার মাধ্যমে ইসলামের বুনিয়াদি শিক্ষা যথাযথভাবে দেওয়া হয় না; বরং বিতর্কিত বিষয়গুলোর ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়, যা মাদ্রাসার আলেমদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করছে। অন্যদিকে, সাধারণ শিক্ষায় ধর্মীয় শিক্ষাকে প্রায় বাদ দেওয়া হয়েছে এবং নৈতিকতা, দেশপ্রেম ইত্যাদি বিষয়ও অনুপস্থিত। ফলে, শিক্ষিতরা দুর্নীতি, অর্থপাচার এবং অন্যান্য অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য আমরা একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রস্তাব দিয়েছি, যেখানে মাদ্রাসা ও সাধারণ শিক্ষা একত্রিত হয়ে নীতি-নৈতিকতা, ধর্মীয় শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষার সমন্বয়ে এমন একটি ব্যবস্থা গড়ে উঠবে, যা দেশপ্রেমিক ও সত্যনিষ্ঠ নাগরিক তৈরি করবে।
“শাসন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে আমাদের প্রস্তাব হল, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ হবেন রাষ্ট্রপ্রধান যাকে ইসলামের পরিভাষায় যাকে বলা হয় ইমাম বা খালিফা। প্রতিরক্ষা, বিচারবিভাগ তাঁর অধীনে থাকবে। তার সহকারী হিসাবে একজন উপ-রাষ্ট্রপতি থাকবেন। রাষ্ট্রপ্রধানের অধীনে দুটো বিভাগ থাকবে- আইনসভা ও মন্ত্রিসভা। জনগণের দ্বারা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা শুরু পরিষদে থাকবে। প্রতিটি ব্যক্তির আমির থাকবে যা চেইন অব কমান্ডের মাধ্যমে রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে যুক্ত হবে। মন্ত্রিসভার অধীনে সচিবালয় পরিচালিত হবে। আমরা নির্বাচন ব্যবস্থারও কিছু সংশোধন প্রস্তাব দিয়েছি যেন কোনোভাবে দুর্নীতে না হয়। আমাদের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে- কেউ নিজে থেকে প্রার্থী হতে পারবে না। সরকার তদন্ত করে জনমত নিয়ে একটা প্যানেল মনোনীত করবে। একই পোস্টারে সব প্রার্থীর নাম পরিচয় থাকবে। কাউকে নির্বাচন করার জন্য টাকা খরচ করতে হবে না, প্রচারণা করতে হবে না। সব ব্যয় বহন করবে নির্বাচন কমিশন। জনগণ তাদেরকে প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত করবে। এবং সেই ধরনের লোকেরা পার্লামেন্টে এসে তখন তার আইন প্রণয়ন করবে।”
“রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রস্তাবনায় আমরা চলমান বিভিন্ন মতাদর্শের ওপর ভিত্তি করে রাজনীতি করার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা আরোপ করার প্রস্তাব করেছি। জনদুর্ভোগ সৃষ্টিকারী সকল কর্মসূচি নিষিদ্ধ করার জন্য সুপারিশ করেছি। পুলিশ, আইনশৃঙ্খলা এবং অন্যান্য ডিপার্টমেন্ট সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রস্তাবনা আমরা মূল বইয়ে বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করেছি। এছাড়া, আমরা বলেছি যে, সমগ্র জাতিকে সামরিক শৃঙ্খলা ও প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে এবং নিয়মিত বাহিনীর পাশাপাশি সুস্থ, সবল নাগরিকদের নিয়ে একটি গণবাহিনী গড়ে তুলতে হবে।” -যোগ করেন তিনি।
এসময় তিনি হেযবুত তওহীদের প্রস্তাবনাকে সুসমন্বিত, আধুনিক সমাজের সাথে সংগতিপূর্ণ বলে উল্লেখ করে বলেন, “সরকার এই প্রস্তাবনা বিবেচনা করলে দেশের মানুষের ভাবনা, চেতনা এবং আশা-আকাক্সক্ষার পূর্ণ প্রতিফলন ঘটাতে সক্ষম হবে। এটি অত্যন্ত বাস্তবভিত্তিক এবং যুক্তিসঙ্গত।” যদি সরকার এই প্রস্তাবনাটি গ্রহণ করেন, তবে বর্তমানে চলমান রাজনৈতিক সংকট ও বিরোধগুলো নির্মূল হবে এবং একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা হবে বলেও উল্লেখ করেন।
সংবাদ সম্মেলনের মূলবক্তব্য শেষে সংস্কার বিষয়ের বিভিন্ন বিষয়ে আলোকপাত করেন হেযবুত তওহীদের তথ্য সম্পাদক এসএম সামসুল হুদা, সাহিত্য সম্পাদক রিয়াদুল হাসান। অনুষ্ঠান পরিচালনায় ছিলেন ঢাকা বিভাগ হেযবুত তওহীদের সহ-সভাপতি আল আমিন সবুজ। আরও উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক যোগাযোগ বিষয়ক সম্পাদক ইলা ইয়াসমিন, ঢাকা বিভাগীয় নারী সম্পাদক তাসলিমা আক্তার প্রমুখ।