নিজস্ব প্রতিনিধিঃ আজ ৮ ডিসেম্বর, রবিবার জলবায়ু ন্যায্যতার দাবিতে “ঢাকা ঘোষণা’র” মধ্য দিয়ে দুই দিনব্যাপী জলবায়ু ন্যায্যতা সমাবেশ শেষ হয়। কৌশল নির্ধারণী অধিবেশনের মধ্য দিয়ে সমাবেশের দ্বিতীয় দিন শুরু হয়। অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন সমাবেশ আয়োজক কমিটির আহ্বায়ক এবং ধরা’র উপদেষ্টা ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার। অধিবেশনে যৌথভাবে সহায়কের ভূমিকা পালন করেন ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশের সমন্বয়ক শরীফ জামিল, সিপিআরডি’র প্রধান নির্বাহী মো. শামসুদ্দোহা, এপিএমডিডি’র সিনিয়র অ্যানার্জি ক্যাম্পেইনার মালো তাবুইস ন্যুয়েরা এবং মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর মোহাম্মদ জহিরুল হক।
দুই দিনব্যাপী এই সমাবেশে দেশি ও বিদেশি অংশীজন জলবায়ু, জ্বালানি এবং পরিবেশ সুরক্ষায় আলোচনা করেন। সমাবেশে জাতীয় পর্যায়ের বক্তাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাননীয় উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাননীয় উপদেষ্টা ফারিদা আখতার, অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, জালাল আহমেদ, চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন; ফারাহ কবির, কান্ট্রি ডিরেক্টর, অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ; শরীফ জামিল, কো-অর্ডিনেটর ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ; প্রফেসর ড. মোহাম্মদ জহিরুল হক, ভাইস চ্যান্সেলর, মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি; রেজাউল করিম চৌধুরী, চিফ মডারেটর, ইকুইটি বিডি; মো. শামসুদ্দোহা, চিফ এক্সিকিউটিভ, সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (সিপিআরডি); শাহরিয়ার আহমেদ চৌধুরী, চেয়ারম্যান, সেন্টার ফর রিনিউএবল এনার্জি সার্ভিসেস লিমিটেড (সিআরইএসএল); মোহন কুমার মন্ডল, নির্বাহী পরিচালক, লিডার্স; এবং রাবেয়া বেগম, নির্বাহী পরিচালক, শরিয়তপুর ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি (এসডিএস) প্রমূখ।
বিদেশি অতিথিদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ডোনা লিসেনবি, সিইও, রিভারফক্স এনভায়রনমেন্টাল; আয়ান রিভেরা, ন্যাশনাল কোঅর্ডিনেটর, ফিলিপাইন মুভমেন্ট ফর ক্লাইমেট জাস্টিস (পিএমসিজে); সাঈদ বেলুচ, সাধারণ সম্পাদক, পাকিস্তান ফিশারফোক ফোরাম; ইয়ুকি তানাবি, প্রোগ্রাম ডিরেক্টর, জেএসিএসইএস; আয়ুমি ফুকাকুসা, এফওই জাপান (ভার্চুয়াল); মালো তাবিওস নুয়েরা, সিনিয়র এনার্জি ক্যাম্পেইনার, এপিএমডিডি; মাকিকো আরিমা, জাপান ফাইন্যান্স ক্যাম্পেইনার, অয়েল চেঞ্জ ইন্টারন্যাশনাল ও ফসিল ফ্রি জাপান।
অধিবেশনসমূহ শেষে জলবায়ু ন্যায্যতা সমাবেশ থেকে উঠে আসা দাবিসমূহ উত্থাপন করার লক্ষ্যে আয়োজক কমিটির আহ্বায়ক এবং ধরা’র উপদেষ্টা ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদারের সভাপতিত্বে “মিট দ্য প্রেস” অনুষ্ঠানে আয়োজক কমিটি এবং ধরা’র সদস্য সচিব শরীফ জামিল জলবায়ু ন্যায্যতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১৩ দফা দাবি উত্থাপন করেন। এসময় উপস্থিত ছিলেন আয়োজক কমিটির কৌশল ও প্রস্তাবনা ওয়ার্কিং গ্রুপের সমন্বয়ক মো. শামসুদ্দোহা।
মিট দ্য প্রেসে শরীফ জামিল বলেন, সমাবেশ লক্ষ্য করে যে, জীবাশ্ম জ্বালানির উপর বাংলাদেশ সরকারের নির্ভরতা কার্যত একইভাবে চলমান রয়েছে। আলোচনায় অংশগ্রহণ করে বক্তারা ২৯ তম জলবায়ু সম্মেলনের সিদ্ধান্ত পর্যালোচনা করতে গিয়ে জলবায়ু তহবিল গঠনে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি না থাকায় বিস্ময় ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন বরং যে সমস্ত সিদ্ধান্ত হয়েছে ব্যবসায়িক মুনাফা লাভের মত এবং পথকে সুগম করবে।
উপকূল থেকে আসা স্থানীয় জনগোষ্ঠী চরম আবহাওয়াজনিত দুর্যোগ, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, জলাবদ্ধতা, লবণাক্ততা, ভাঙ্গন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির পাশাপাশি নদ-নদী, বনাঞ্চল ও প্রাকৃতিক সম্পদ বিনষ্টের ফলে খাদ্য সংকট সামাজিক নিরাপত্তা, শিক্ষা, বাসস্থানসহ বিভিন্ন মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত এবং জীবিকা ও ভিটা হারিয়ে স্থায়ী উদ্বাস্তে পরিণত হচেআছ।
অপরিকল্পিত শিল্পায়ন, দূষক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান যেমন কয়লা, গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র উপকূলের প্রাণ-প্রকৃতির উপর ইতিমধ্যে চরম বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করেছে। তাই সমাবেশ রামপাল থেকে শুরু করে মাতাবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ সকল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিলের দাবি জানিয়ে সকল গ্যাস ও এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিকল্পনাও বাতিলের দাবি জানান।
জলবায়ু ন্যায্যতা সমাবেশ-এর আহ্বানসমূহ:
১. স্থানীয় এবং প্রেক্ষাপটভিত্তিক অভিযোজন পরিকল্পনার উন্নয়ন: জনগণের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে স্থানীয় পর্যায়ে অভিযোজন পরিকল্পনা তৈরি করা, যাতে জনগণকে তাদের বাস্তবায়নকারী প্রকল্পে একাধিক পক্ষের অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠা এবং তাদের বাস্তবায়নে জনগণের মনিটরিং ব্যবস্থা চালু করা হয়।
২. ব্যাপক ঝুঁকি বিশ্লেষণ: জলবায়ু পরিবর্তন এবং উন্নয়নগত চাপের প্রভাবে নারী, আদিবাসী জনগণ এবং প্রান্তিক পেশাদার গ্রুপগুলোর উপর যে ভিন্ন ও অসম্পূর্ণ প্রভাব পড়ছে, তার সঠিক মূল্যায়ন করা, যাতে এদের অবহেলা ও বৈষম্য দূর করা যায়।
৩. জলবায়ু পরিবর্তন এবং উন্নয়ন প্রকল্পগুলির পরিবেশগত এবং সামাজিক প্রভাব মূল্যায়ন: কোনো প্রকল্প পরিকল্পনা এবং ডিজাইনের পূর্বে পরিবেশগত ও সামাজিক প্রভাব মূল্যায়ন বাধ্যতামূলক করা। প্রকল্পগুলোকে অবশ্যই পরিবেশগত ও সামাজিক সুরক্ষা, লিঙ্গ এবং আদিবাসী জনগণের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। প্রকল্পগুলো কখনও স্থানীয় পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য, বাস্তুতন্ত্র এবং জনসাধারণের সম্পদ নষ্ট করতে পারে না।
৪. বড় আকারের অবকাঠামো প্রকল্পগুলির পরিবেশগত ও সামাজিক প্রভাব মূল্যায়ন: ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের অংশগ্রহণে স্বচ্ছ, বৈজ্ঞানিক এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিবেশগত এবং সামাজিক প্রভাব মূল্যায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
৫. সীমান্তবর্তী নদী ব্যবস্থা এবং দেশের সব নদী, খাল ও প্রাকৃতিক জলাভূমি রক্ষার জন্য পর্যাপ্ত ও সুষম মিঠা পানির প্রবাহ নিশ্চিত করা।
৬. কোম্পানি, কয়লা প্লান্ট ইত্যাদিকে আইনগতভাবে দায়বদ্ধ করা, যাতে তারা ফসিল ফুয়েল এবং উন্নয়ন প্রকল্পগুলির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের ক্ষতিপূরণ দেয়।
৭. কৃষক এবং মৎস্যজীবীদের জীবিকা এবং আয় উপার্জনের উৎস পুনরুদ্ধার করা। বিকল্প জীবিকা অর্জনের উৎস নিশ্চিত করা।
৮. বাঁধ এবং পোল্ডার সংস্কার ও শক্তিশালী করা, যেখানে শহর এবং কৃষি বা চাষযোগ্য ভূমি রয়েছে, জীবন এবং জীবিকা রক্ষার জন্য। পোল্ডারের মধ্যে জলাবদ্ধতা সমস্যা সমাধান এবং সমুদ্র, নদী, জলাভূমি এবং প্লাবনভূমির দিকে খোলামেলা দৃষ্টিকোণ থেকে বিকল্প শহর ও জীবিকা পরিকল্পনার মাধ্যমে ব-দ্বীপের চরিত্র রক্ষা করা।
৯. বাঁধ ও গ্যাস-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলির সম্পূর্ণ তথ্য প্রকাশ করার আহ্বান, যা অন্তর্ভুক্ত করবে ঋণ চুক্তি, উৎপাদন ভাগাভাগি চুক্তি, পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন (ইআইএ), পরিবেশগত ও সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থাসমূহ।
১০. জনগণের/নাগরিকদের জন্য সামাজিক এবং পরিবেশগত কমপ্লায়েন্সের উপর নিরীক্ষা চালু করা।
১১. জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদন, পরিবহন এবং ব্যবহার সম্পর্কিত সকল ধরণের ভর্তুকি শতভাগ প্রত্যাহার করার আহ্বান, এবং এসব ভর্তুকি পুনঃনির্দেশিত করা উচিত নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস সম্প্রসারণের জন্য।
১২. সব কয়লা-চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিত্যাগের জন্য একটি পরিষ্কার রোডম্যাপ প্রণয়ন এবং নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসের দিকে সরে আসার আহ্বান।
১৩. জলবায়ু ন্যায় সংস্থা দাবি করছে যে, বাংলাদেশ উপকূল এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে পানি, বায়ু এবং মাটি দূষণ অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।