নিজস্ব প্রতিনিধি : এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া।।
১২ ডিসেম্বর, ২০২৫, স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, মুক্তিযুদ্ধকালিন প্রবাসী সরকারের উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারম্যান মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ১৪৫তম জন্ম জয়ন্তী। প্রয়াত কণ্ঠশিল্পী ফকির আলমগীরের সেই বিখ্যাত গান, ‘ভাসানীর ভাষা ভেসে আসে ওই মিছিলের গর্জনে/ কিষান–কামার এই বাংলার মেহনতি লাখো জনে।’ আজও শোষিত নিপিড়িত মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে ভাসানীকে বার বার সামনে এনে দাড় করায়। যুগে যুগে জনে-জনের অন্তরে জিইয়ে আছেন মজলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। যিনি আমৃত্যু কৃষক, শ্রমিক, জেলে, মজুর, কামার, কুমার, তাঁতি ও খেটে খাওয়া মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় লড়াই করে গেছেন।
ভাসানী ১৮৮০ সালের ১২ই ডিসেম্বর ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির পাবনা জেলার সয়াধানগড়া পল্লীতে (বর্তমানে বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জ জেলায়) জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা হাজী শারাফত আলী। হাজী শারাফত আলী ও বেগম শারাফত আলীর পরিবারে ৪টি সন্তানের জন্ম হয়। একটি মেয়ে ও তিনটি ছেলে। মোঃ আব্দুল হামিদ খান সবার ছোটো। তার ডাক নাম ছিল চেগা মিয়া। ছেলে-মেয়ে বেশ ছোটো থাকা অবস্থায় হাজী শারাফত আলী মারা যান। কিছুদিন পর এক মহামারীতে বেগম শারাফত ও দুই ছেলে মারা যায়। বেঁচে থাকেন ছোট্ট শিশু আব্দুল হামিদ খান।
পিতৃহীন ভাসানী প্রথমে কিছুদিন চাচা ইব্রাহিমের আশ্রয়ে লালিত-পালিত হন। ওই সময় ইরাকের প্রখ্যাত সুফী ও ধর্ম প্রচারক হযরত নাসির উদ্দীন বোগদাদী (রহ.) সিরাজগঞ্জে আসেন। ভাসানী তাঁর আশ্রয়ে কিছুদিন কাটান। এরপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কিছুদিন পূর্বে ১৮৯৩ সালে তিনি পাঁচবিবির জমিদার শামসুদ্দিন আহম্মদ চৌধুরীর বাড়িতে যান। সেখানে তিনি মাদ্রাসার মোদাররেসের কাজ করেন এবং জমিদারের ছেলে-মেয়েকে পড়ানোর দায়িত্ব নেন। ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দে পীর সৈয়দ নাসীরুদ্দীন বোগদাদি (রহ.)’র সাথে আসাম গমন করেন। ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। ইসলামি শিক্ষার উদ্দেশ্যে ১৯০৭ সালে দেওবন্দ যান। দুই বছর সেখানে অধ্যয়ন করে আসামে ফিরে আসেন। ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস ময়মনসিংহ সফরে গেলে তার ভাষণ শুনে ভাসানী অণুপ্রাণিত হন। ১৯১৯ সালে কংগ্রেসে যোগদান করে অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে দশ মাস কারাদণ্ড ভোগ করেন। ১৯২৩ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন স্বরাজ্য পার্টি গঠন করলে ভাসানী সেই দল সংগঠিত করার ব্যাপারে ভূমিকা পালন করেন। ১৯২৫ সালে তিনি জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলার জমিদার শামসুদ্দিন মহম্মদ চৌধুরীর মেয়ে আলেমা খাতুনকে বিবাহ করেন। ১৯২৬ সালে তিনি তার সহধর্মিণী আলেমা খাতুনকে নিয়ে আসাম গমন করেন এবং আসামে প্রথম কৃষক-প্রজা আন্দোলনের সুত্রপাত ঘটান। ১৯২৯-এ আসামের ধুবড়ী জেলার ব্রহ্মপুত্র নদের ভাসান চরে প্রথম কৃষক সম্মেলন আয়োজন করেন। এখান থেকে তার নাম রাখা হয় “ভাসানীর মাওলানা”। এরপর থেকে তার নামের শেষে ভাসানী শব্দ যুক্ত হয়।
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী আফ্রো-এশিয়া-লাতিন আমেরিকার মানুষের কাছে ‘মজলুম জননেতা’ হিসেবে পরিচিত। তিনি ছিলেন, ব্রিটিশ ভারতের অন্যতম তৃণমূল রাজনীতিবিদ ও গণআন্দোলনের নায়ক। বেশ কিছু সাধারণ ও স্থানীয় নির্বাচনে জয়ীও হয়েছিলেন, তবে কখনো ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করেননি। তার নেতৃত্বের ভিত্তি ছিল কৃষক শ্রমিক জনসাধারণ, যাদের অধিকার এবং স্বার্থরক্ষার জন্য তিনি নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম করে গেছেন। ১৯৪৭-এ সৃষ্ট পাকিস্তান ও ১৯৭১-এ প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। কৃষক আন্দোলনের নেতা হিসেবে তার রাজনৈতিক জীবনের শুরু। তিনি সবসময় রাজনীতি করেছেন কৃষক-শ্রমিক, মেহনতি মানুষের তথা অধিকার বঞ্চিত মানুষের জন্য। তার নেতৃত্বের ভিত্তি ছিল কৃষক-শ্রমিক জনসাধারণ, যাদের অধিকার এবং স্বার্থরক্ষার জন্য তিনি নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম করে গেছেন। এদেশের নির্যাতিত-নিপীড়িত, মেহনতি মানুষের মুক্তির দিশারি ছিলেন।
মাওলানা ভাসানী ছিলেন বাংলার মজলুম জননেতা, যিনি সারাজীবন কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করেছেন। স্বাধীনতা, জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্রের এক অনন্য মিশ্রণ তাঁর রাজনৈতিক দর্শন, যা তাঁকে একজন দূরদর্শী নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তিনি কখনোই আপোষ করেননি, বরং নিজের আদর্শের প্রতি অবিচল থেকেছেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ, জমিদারদের নির্যাতন এবং পাকিস্তানি শাসকদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে তাঁর সংগ্রাম ছিল ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়। ভাসানী ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রথম স্বপ্নদ্রষ্টা। ১৯৫৭ সালের কাগমারী সম্মেলনে তিনি পাকিস্তানের পশ্চিমা শাসকদের বিরুদ্ধে প্রথমবারের মতো পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতার ঐতিহাসিক ঘোষণা দেন। তাঁর এই ঘোষণা ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে তৈরি হয়েছিল বাংলাদেশের প্রথম জাতীয়তাবাদী ও সমাজতান্ত্রিক আদর্শের মিশ্রণে একটি রাজনৈতিক দল, ন্যাপ (ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি)।
মওলানা ভাসানী ১৯৭০ সালের নির্বাচনে সরাসরি অংশগ্রহণ করেননি। এর পেছনে দুটি কারণ ধরা হয়- প্রথমত, তিনি মনে করতেন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কখনোই পূর্ব পাকিস্তানের ভোটারদের রায় মেনে নেবে না। দ্বিতীয়ত, নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব নয় বলে তার ধারণা ছিল। বয়স এবং শারীরিক দুর্বলতার কারণে তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে সরাসরি অংশ নিতে পারেননি। তবে পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে তার আজীবন কড়া অবস্থান এবং শোষিত মানুষের পক্ষে কথা বলা মুক্তিযুদ্ধে প্রেরণা জুগিয়েছিল। ১৯৫৫ সালে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেয়া হয়। এটি ছিল সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিপরীতে একটি সেক্যুলার রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম তৈরির প্রচেষ্টা। ভাসানী বিশ্বাস করতেন, ধর্মনিরপেক্ষ একটি দলই কেবল পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের সব সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। তবে এটি অনেকের কাছে দ্বিধাজনক মনে হয়েছে, কারণ অন্যদিকে তিনি ইসলামি নীতির ওপর ভিত্তি করে সমাজ গড়ার কথাও বলতেন বার বার।
মওলানা ভাসানীর আদর্শে ইসলামের ভূমিকা ছিল অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি সকলসময়ই ইসলামি ন্যায়বিচার এবং শোষণহীন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথা বলতেন। একদিকে তিনি সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করেন, অন্যদিকে ধর্মীয় মূল্যবোধকে রাজনীতির ভিত্তি করতে চান। মাওলানা ভাসানী ছিলেন হাড়ে, মাংসে, অস্থিমজ্জায় কৃষক সম্প্রদায়ের নেতা। স্বভাবে, আচরণে, জীবনযাপন পদ্ধতিতে তিনি নিজেও ছিলেন মহান কৃষক। তাঁর চিন্তাভাবনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল কৃষকসমাজ। যখনই কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন, তিনি মনে করেছেন, এই দলটির সঙ্গে কাজ করলে কৃষকসমাজের দাবিদাওয়া এগিয়ে নিতে পারবেন। পরক্ষণে যখনই তাঁর মনে হয়েছে, এই দলটি কৃষকসমাজের স্বার্থবিরোধী, কায়েমি স্বার্থের তল্পিবাহকে পরিণত হয়েছে। তখনই দল ছাড়তে তাঁর একমুহূর্ত সময়ও ব্যয় হয়নি। নিপীড়িত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ভাসানী ক্ষমতার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতেন। কিন্তু ক্ষমতায় আসীন হননি।
তিনি যেমন সুফী ছিলেন, তেমনি ছিলেন বাংলাদেশের মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনের অগ্রনায়ক। দূরদৃষ্টি সম্পন্ন এই মানুষটিই হাজার হাজার লোক নিয়ে লংমার্চ করেছেন ফারাক্কা বাঁধের বিরুদ্ধে। কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে একটা নদী আটকে দিলে দেশে এর কী প্রভাব পড়তে পারে। নদী আমাদের টিকে থাকার সঙ্গে সম্পর্কিত। আবার এ লং মার্চের নেতৃত্ব যথন দিয়েছিলেন তখন তিনি প্রায় ৯৬ বছরের বৃদ্ধ। কিন্তু বাস্তব এই যে জীবনজুড়েই তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে সক্রিয় ছিলেন। প্রতিটা সংকট নিয়েই তিনি কথা বলেছেন। মওলানা ভাসানী যেমন দক্ষ রাজনৈতিক ছিলেন, তেমনি রাজনীতির সরল কথকও ছিলেন। আমাদের দেশে অধিকাংশ ব্যক্তি মার্ক্সবাদ নিয়ে কথা বলার সময় এমন শব্দ ব্যবহার করেন যে লোকে তাদের কথায় মনোযোগ ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়। কিন্তু মওলানা ভাসানীর বক্তব্যের মধ্যে কঠিন গালভারি কোনো তাত্ত্বিক শব্দের ব্যবহার থাকত না। তিনি জীবনভর আন্দোলন আর রাজনৈতিক দর্শনকে সরল করে মানুষের সামনে উপস্থাপন করেছেন।
মওলানা ভাসানীকে নিয়ে রচিত সৈয়দ ইরফানুল বারীর লেখা ‘আমার ভালোবাসা মওলানা ভাসানী’ থেকে জানা যায়, ভাসানীর কান পচা একটা কুকুর ছিল। কুকুরের প্রতি তার যে মমত্ব ছিল তা কল্পনাতীত। আবার তিনি যমুনার ওপারে যাওয়ার সময় চরের মধ্যে কখনো নৌকা আটকে গেলে নেমে ওই নৌকা নিজেই ঠেলেছেন। তিনি এমন মায়ময় ও সরল জীবনের অধিকারীও ছিলেন। তাকে জনমানুষের কণ্ঠস্বর হিসেবেও মনে করা হয়। কিন্তু তিনি কখনো সাম্প্রদায়িকতা করেছেন, এমন কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। যেখানে যেখানে তার সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন, সেখানেই তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে কথা বলেছেন। মওলানা ভাসানী কখনো রাজনৈতিক উত্তরাধিকারের কথা চিন্তা করেননি। নিজের সন্তানদের তিনি কখনো সামনে আনেননি। তাকে কোনোদিন আশাহত হতে দেখা যায় নাই। তিনি ভেবেছেন যে এটা তার কাজ, এটা করতে হবে এবং তিনি সে কাজ করেছেন। একটা কর্মীর জীবন। সেই আসাম থেকে শুরু করে তিনি একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন।
উপমহাদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মওলানা ভাসানীকে চিত্রিত করেছে উপমহাদেশের রাজনৈতিক বিক্ষোভ ও বৃহত্তর গণ-আন্দোলনের অগ্নিপুরুষ হিসেবে। আবার কোন কোন বিশ্লেষকগন তাঁকে আখ্যায়িত করেছেন একজন ক্ষণজন্মা রাজনীতিক হিসেবে। ব্রিটিশ শাসনামলে আসামে বাঙালিদের অধিকার প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে ব্রিটিশ শাসন ও উপনিবেশবাদ, সামন্তবাদ ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে মওলানা ভাসানী হয়ে উঠেন আন্দোলনের প্রতীক। জীবনের প্রায় অর্ধেক সময় তিনি ভারতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ও পাকিস্তানি ফ্যাসিবাদী সরকারের বন্দিশালায় কাটিয়েছেন। কিন্তু কখনোই গণমাণুষের এই ‘মজলুম জননেতা’ মেহনতি ও ভুখানাঙা মানুষের অধিকার আদায়ের প্রশ্নে কারো সঙ্গে আপস করেননি। এ বাংলার স্বাধীনতা ছিল মওলানা ভাসানীর আজন্ম লালিত স্বপ্ন। তাই মওলানা ভাসানীর বুকে একটি স্থায়ী আসন গড়ে নিয়েছিলেন সংগ্রামী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে যখনই জনতার এই দুই অবিসংবাদিত নেতা মিলিত হয়েছেন, তখনই দেখা গেছে বঙ্গবন্ধুকে তাঁর পিতৃতুল্য এই বর্ষীয়ান নেতাকে জড়িয়ে ধরে তাঁর বুকে অপরিসীম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় মাথা রেখেছেন। যা ছিল এক বিরল দৃশ্য।
সময়ের প্রয়োজনে মানুষের মধ্যে ভাসানীর নীতি-আদর্শের আবার জাগরণ হচ্ছে। দেশ-বিদেশের নানা সংকট ও সম্ভাবনায় ভাসানী প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন ও তিনি ফিরে ফিরে আসছেন। বর্তমানে ভাসানীকে নিয়ে বিদেশেও গবেষণা হচ্ছে, চর্চা হচ্ছে, হচ্ছে সভা ও সম্মেলন। অথচ দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে কিছু হচ্ছে না। জাতীয় জীবনের রাজনীতির অঙ্গনে মাওলানা ভাসানী আজ অবহেলিত। দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকদের কাছে তাঁর প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। মনে রেখেছে তাঁকে সাধারণ মানুষ। মনে রাখতে হবে, ভাসানীর কাজ ফুরায়নি। পশ্চিম পাকিস্তানের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে ১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনে ভাসানীই প্রথম পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশ স্বাধীন করার হুংকার দিয়েছিলেন। অত্যাচারী শাসক ও শোষকের বিরুদ্ধে ভাসানীর ‘খামোশ’ উচ্চারণ সর্বকালেই প্রাসঙ্গিক। ভাসানীর বলিষ্ঠ কণ্ঠের ভাষণ এখনো ভেসে বেড়ায় গণমানুষের হৃদয়ে।
মওলানা আজকে কতখানি প্রাসঙ্গিক? নূরুল কবীরের লেখা ‘রেড মাওলানা’ কিংবা সৈয়দ আবুল মকসুদ তার ‘ভাসানীর জীবনী’তে তাকে অমর করে রেখেছেন, এছাড়া আছে সৈয়দ ইরফানুল বারীর অনেকগুলো গ্রন্থ। তার পরও বলা যায়, মওলানার জীবনের বহুক্ষেত্র আজও অনালোচিত, অনালোকিত। মওলানার বিবৃতি ও বক্তৃতার সংকলনে কিংবা তার চীন ভ্রমণের স্মৃতিচারণে রাষ্ট্রনীতি ও অর্থনীতি বিষয়ে তার যে গভীর দার্শনিক বোধের সাক্ষাত মেলে, তা নিয়ে যথেষ্ট চর্চা আমাদের দেশে নেই, কিংবা বলা যায় উলটো ম্রিয়মান হয়েছে। কৃষকের মুক্তির যে কর্মসূচি মওলানা দিয়েছিলেন, তা এখনকার অর্থনীতির চিন্তায় খুবই অনুপস্থিত, অথচ এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ আজও কৃষক। জাতীয় মুক্তির রাজনীতি তিনি করেছেন, কিন্তু কখনোই উগ্রজাতীয়বাদের খপ্পড়ে পরেননি। বরং আন্তর্জাতিকতা আর বিশ্বমানবতার বোধই তার মাঝে প্রবল। ভাসানীর এই রাজনীতিই তাকে সমকালীন আফ্রো-এশীয়-লাতিন আমেরিকান রাজনীতিতে অন্যতম ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছিল। এদেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর গণতান্ত্রিক সংগ্রামেও মওলানা ভাসানী প্রেরণা হিসেবে থেকেছেন।
মওলানা ভাসানীর জীবন এবং রাজনীতি আমাদের শিক্ষা দেয় যে শোষিত মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য সংগ্রাম অনেক ক্ষেত্রেই কঠিন এবং বিভ্রান্তিকর হতে পারে। তার আদর্শ আমাদের ইতিহাসের মূল্যবান অংশ। মওলানা ভাসানীর জন্মবার্ষিকীতে আমরা স্মরণ করি তাঁর অবদান এবং সংগ্রামের ইতিহাস। তিনি ছিলেন এক মহান নেতা, যিনি আজও প্রেরণার উৎস। পৃথিবীর নানা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর রাজনৈতিক জীবন নিয়ে গবেষণা চলছে, যা প্রমাণ করে তাঁর অবদান কতটা গভীর ও বিশাল। তিনি শুধু একজন রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক দিকনির্দেশক, এক সংগ্রামী মহাপুরুষ, যিনি মেহনতি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় জীবন বাজি রেখেছিলেন। তাঁর জীবন ও সংগ্রাম আমাদের শেখায়, কীভাবে দেশ ও জাতির উন্নয়নে নিজেকে উৎসর্গ করতে হয়।
মওলানা ভাসানী চিরকাল আমাদের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন, তাঁর আদর্শ, তাঁর সংগ্রাম ও তাঁর মুক্তিযুদ্ধের পথিকৃৎ হিসেবে।

