রুপসীবাংলা৭১ অন্যান্য ডেস্ক : ইসলাম সর্বক্ষেত্রে মানবজীবনের সুসামঞ্জস্য ও ভারসাম্যপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। এর ইবাদত, সমাজনীতি, অর্থনীতি, যুদ্ধ-শান্তি কোনো ক্ষেত্রেই ভারসাম্যহীনতার কোনো স্থান নেই। সর্বক্ষেত্রে ইসলাম মধ্যমপন্থা অবলম্বনের নির্দেশ দেয়। ভারসাম্যপূর্ণ মধ্যমপন্থা অবলম্বন শরিয়তের অন্যতম চাহিদা ও এর স্বভাব।
মিজাজে শরিয়তের ক্ষেত্রে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব রাখে। এটিকেই ‘সিরাতে মুস্তাকিম’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। সহজ, সরল, মাঝামাঝি সে পথ পূর্ব প্রান্তের বা পশ্চিম প্রান্তের নয়, উত্তর প্রান্ত বা দক্ষিণ প্রান্তের নয়, আঁকাবাঁকা নয়, সরল-সঠিক, ‘মাগদুব আলাইহিম’ তথা আল্লাহর গজব নিপতিত বা ‘দাল্লিন’ তথা পথভ্রষ্ট কারো পথ নয়।
আল্লাহ তাআলা কোরআন মাজিদে এই উম্মতকে ‘উম্মাতান ওয়াসাতান’ বা মধ্যপন্থী উম্মত বলে আখ্যায়িত করেছেন।
ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি তোমাদের এক মধ্যমপন্থী জাতিরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছি।’ (সুরা : আল বাকারা, আয়াত : ১৪৩)
ইসলাম কোনো ক্ষেত্রেই বাড়াবাড়িকে প্রশ্রয় দেয় না। ঈমান-আকিদা থেকে নিয়ে সমাজ, পরিবার, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমরনীতি—সর্বত্রই ইসলামের এই ভারসাম্যপূর্ণতা বিধৃত। সাধারণত মানুষকে দেখা যায়, বিশ্বাস ও ইবাদতের ক্ষেত্রে আবেগের শিকার হয়ে যায় বেশি।
ইসলাম ইহুদি ও নাসারাদের বাড়াবাড়ির কথা উল্লেখ করে মুসলিমদের সতর্ক করেছে বারবার। এই বাড়াবাড়ির কারণেও আগের বহু জাতি ধ্বংস হয়েছে। অনেক সময় তারা নবী-রাসুলদের কবরকেও সাজদাগাহে
রূপান্তরিত করে ফেলেছে। হাদিসে আছে, দুনিয়া থেকে শেষ বিদায় নেওয়ার সময়ও যে বিশেষ কয়েকটি বিষয়ে নবীজি (সা.) উম্মতকে সতর্ক করেছেন, এর মধ্যে ছিল ‘কবরকে তোমরা ইবাদত ও সিজদার স্থান বানিয়ে নিয়ো না।’ অর্থাৎ তোমরা কবরপূজা কোরো না।
সাবধান! তোমাদের আগে যারা ছিল তারা তাদের নবী ও নেককার লোকদের কবরকে সিজদার জায়গা হিসেবে গ্রহণ করেছিল, সাবধান! তোমরা কবরকে সিজদার জায়গা বানিয়ো না। আমি তোমাদের এ বিষয়ে নিষেধ করছি। (ইমাম মুসলিম, আস-সহিহ, হাদিস : ৫৩২)
এমনকি ইবাদত-বন্দেগির ক্ষেত্রেও ইসলাম বাড়াবাড়ি পছন্দ করেনি। নবীজি (সা.) ইরশাদ করেছেন,‘দ্বিন খুবই সহজ। যে-ই দ্বিনকে কঠোর করবে সে পরাজিত হবে।’ (ইমাম বুখারি, আস-সহিহ, হাদিস : ৩৯)
কোরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা তোমাদের দ্বিনের বিষয়ে বাড়াবড়ি কোরো না।’
(সুরা : আল মায়িদা, আয়াত : ৭৭)
উমর (রা.) বলেছেন, ‘বাড়াবাড়ি করা থেকে আমাদের নিষেধ করা হয়েছে।’ (ইবন হাজার, ফতহুল বারি : ১৩/২৮৫)
নবী (সা.) একবার মসজিদে একটা দড়ি টানানো দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এটা কেন? একজন বললেন, জয়নব (রা.) এখানে নামাজ আদায় করেন। ক্লান্তি দেখা দিলে এতে ধরে বিশ্রাম করেন।
নবী (সা.) বলেন, এটি খুলে ফেলো। নফল নামাজ আদায় করবে যতক্ষণ শরীরে স্ফূর্তি থাকবে। ক্লান্তি দেখা দিলে ঘুমিয়ে পড়বে। (ইমাম মুসলিম, আস-সহিহ, হাদিস : ৭৮৪; ইমাম আহমদ, আল মুসনাদ, হাদিস : ১২৭০৮)
আনাস (রা.) বলেন, একবার কয়েকজন সাহাবি গৃহাভ্যন্তরে নবীজি (সা.)-এর ইবাদত-বন্দেগি সম্পর্কে খোঁজ নিতে উম্মুল মুমিনিন আয়েশা (রা.)-কে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে জানতে পারেন যে তিনি ইবাদতও করেন এবং নিদ্রাও যান। কোনো দিন রোজাও রাখেন আবার কখনো কখনো তা রাখেন না। প্রয়োজনে স্ত্রীগমনও করে থাকেন।
এই সাহাবিদের কাছে মনে হলো নবী (সা.)-এর তো কোনো গুনাহ নেই, তিনি নিষ্পাপ, এর পরও যতটুকু ইবাদত-বন্দেগি করেন তা তাঁর জন্য যথেষ্ট। আমরা তো পাপে নিমজ্জিত। আমাদের আরো অনেক বেশি ইবাদত-বন্দেগি করতে হবে। সে মতে একজন বলেন, আমি কখনো রোজা ছাড়া থাকব না। একজন বলেন, সারা রাত জেগে আমি ইবাদতে কাটিয়ে দেব। আরেকজন বলেন, আমি কখনো স্ত্রী গ্রহণ করব না।
নবী (সা.)-এর কানে এ কথা গেলে তিনি খুবই ক্ষুব্ধ হন। সাহাবিদের জমায়েত করে বলেন, কী হলো—এই দলের তারা এরূপ কথা বলে! আমি তো (নফল) নামাজ পড়ি আবার নিদ্রায়ও যাই। (নফল) রোজা রাখি, আবার রাখিও না। বিয়েশাদিও করেছি। যে ব্যক্তি আমার সুন্নাহ ও রীতির বিষয়ে অনাগ্রহী হবে সে আমার দলভুক্ত নয়। (ইমাম বুখারি, আস-সহিহ, হাদিস : ৪৭৭৬; ইমাম মুসলিম, আস-সহিহ, হাদিস : ১৪০১)
এই ভারসাম্যপূর্ণ পরিমিতি বোধ শরিয়তের এক অপরিমেয় সৌন্দর্য। আকিদা ও বিধি-বিধানের সব ক্ষেত্রে এই সুসামঞ্জস্য পরিমিতি বোধের লক্ষণ সুস্পষ্ট।
রুপসীবাংলা৭১/এআর

