নিজস্ব প্রতিনিধিঃ দুই দশক ধরে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতায় আইনটির কিছু দুর্বলতা চিহ্নিত হয়েছে এবং সময়ের সাথে কিছু নতুন চ্যলেঞ্জ সামনে এসেছে। তাই জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় আইনটিকে পুনঃসংশোধনের মাধ্যমে আরো শক্তিশালী করা জরুরি। কিন্তু এই উদ্যোগকে ব্যহত করতে তামাক কোম্পানি বরাবরের মতো নানা বিভ্রান্তকর ও মিথ্যা প্রচারণা চলাচ্ছে। যা জনস্বাস্থ্য ও সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধিতে হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। অথচ তামাক ও তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবসা করে তামাক কোম্পানি বিপুল মুনাফা অর্জন করছে, তার বিপরীতে তামাকজনিত রোগে দেশে প্রতিবছর ১ লক্ষ ৬১ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু এবং ৫ লক্ষাধিক মানুষ নানা জটিল ও কঠিন রোগে আক্রান্ত হওয়া মাধ্যমে দেশের অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করছে বলে জানিয়েছেন দেশের খ্যাতনামা ২০ গণমাধ্যমকর্মী। জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় বিদ্যামন ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইনকে সংশোধনের মাধ্যমে শক্তিশালী করার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের দাবিতে এক যৌথ বিবৃতিতে তারা এ কথা জানিয়েছেন। আজ বুধবার (১৯ নভেম্বর ২০২৫) বিকেলে গণমাধ্যমে তারা এ বিবৃতিটি পাঠিয়েছে।
বিবৃতিতে তারা বলেন, তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার দেশে হৃদরোগ, স্ট্রোক, ক্যান্সার, ফুসফুসের জটিল রোগ, ডায়াবেটিস ইত্যাদি অসংক্রামক রোগের প্রকোপ বাড়াচ্ছে । প্রাণঘাতী এসব রোগের চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। ফলে প্রায় ৪ লক্ষ মানুষ প্রতিবছর শুধুমাত্র চিকিৎসা খরচ যোগাতেই দরিদ্র হয়ে পড়ছে। তামাকের কারণে পরিবেশ, প্রকৃতি ধ্বংস হচ্ছে এবং খাদ্য উৎপাদন হুমকির সম্মুখীন! তামাক কোম্পানিগুলো শিশু-কিশোরদেরকে ভয়াবহ মাদকের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কারণ তামাক হলো অন্য সকল মাদকের প্রবেশ দ্বার।
সরকারের তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালী করার উদ্যোগকে বাধাগ্রস্ত করতে সিগারেট কোম্পানিগুলো নানা অপকৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে উল্লেখ করে বিবৃতিতে তারা বলেন, তামাক কোম্পানির অন্যতম অপকৌশলের একটি হলো, ‘তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালী হলে সরকারের রাজস্ব আয় কমে যাবে’ বলে অপপ্রচার। তামাকজাত দ্রবের মূল্য ও কর বৃদ্ধির বিরোধিতা করতেও তারা একই যুক্তি তুলে ধরে। অথচ প্রকৃত সত্য একেবারেই বিপরীত। গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোবাকো সার্ভের তথ্যানুযায়ী ২০০৯ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে দেশে তামাক ব্যবহার প্রায় ১৮% কমেছে। ২০০৫ সালে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন পাস এবং ২০১৩ সালে আইন আরো শক্তিশালী করা হয়েছে। তারপরও এই সময়ের মধ্যে তামাকজাত দ্রব্যের মূল্য ও কর ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তামাক খাত থেকে রাজস্ব আয় সংক্রান্ত গত ২০ বছরে উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখাযায়, এই সময়ের মধ্যে এই খাত থেকে রাজস্ব আয় বেড়েছে ১৪ গুণ। ফলে এটা পরিষ্কার যে তামাক নিয়ন্ত্রণ হলেও তামাকজাত দ্রব্যের মূল্য ও করহার বাড়ানো হলে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়ে এবং তামাক ব্যবহার কমার মাধ্যমে রোগ ও মৃত্যু কমে।
তামাকজনিত ক্ষতি সম্পর্কে তারা বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জন্স হপকিন্স ইউনিভার্সিটি এর সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২৪ সালে তামাক ব্যবহারের কারণে স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত ব্যয় ছিল ৮৬ হাজার কোটি টাকা। যার মধ্যে ৬৫ হাজার কোটি টাকাই তামাকজনিত স্বাস্থ্য ব্যয়। একই সময়ে তামাক থেকে রাজস্ব আয় ছিলো ৪০ হাজার কোটি টাকা যা তামাক ব্যবহারের কারণে হওয়া অর্থনৈতিক ক্ষতির অর্ধেকেরও কম। দেশে তামাক ব্যবহারজনিত রোগের চিকিৎসা খরচ যোগাতে গিয়ে প্রতিবছর দেশের প্রায় ৪ লক্ষ মানুষ দরিদ্র হয়ে যাচ্ছে।
বিবৃতিতে তারা আরও বলেন, তামাক কোম্পানিগুলো এ তথ্যগুলো আড়াল করতে চায় প্রাণঘাতী পণ্যের ব্যবসা করে মুনাফা অর্জনের জন্য। মানুষের মৃত্যু বা ক্ষতি তাদের বিবেচ্য নয়। মিথ্যাচারের মাধ্যমে তারা প্রকৃত সত্যকে আড়াল করছে। শিশু-কিশোরদের তামাকের নেশায় আকৃষ্ট করতে তারা বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে ধূমপানের স্থান তৈরি করে দিচ্ছে, মূল্য বৃদ্ধি ও খুচরা শালা বিক্রি বন্ধের উদ্যোগকে ব্যহত করছে, বিক্রয় স্থলে আগ্রাসী বিজ্ঞাপন দিচ্ছে, দেশে ভেপিং ও ই-সিগারেটের ব্যবহার বাড়াতে যুবকদের নিয়ে গোপনে ভেপিং মেলার আয়োজন করছে, আইন শক্তিশালি করতে কার্যকর প্রস্তাবসমূহের বিরোধিতা করছে যা তরুণ প্রজন্মকে তামাকে আসক্ত করার মাধ্যমে স্বাস্থ্য ধ্বংসের পায়তারা।
এমতাবস্থায় সাংবাদিকরা সিগারেট কোম্পানির এই ভ্রান্ত প্রচারণা থেকে নীতি নির্ধারকদের সতর্ক থাকা এবং দেশের মানুষের স্বাস্থ্য রক্ষায় অবিলম্বে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন সংশোধনের মাধ্যমে শক্তিশালী করতে পদক্ষেপ গ্রহণ এবং দেশে একটি কার্যকর ও টেকসই তামাক কর ব্যবস্থা প্রবর্তণের জন্য একটি কমপ্রিহেন্সিভ তামাক কর নীতি গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন।
বিবৃতিতে মোট ২০ জন সাংবাদিকবৃন্দ স্বাক্ষর করেন। তারা হলেন, ইত্তেফাক পত্রিকার বার্তা সম্পাদক (ডিজিটাল) সাহানোয়ার সাইদ শাহীন, ডিবিসি নিউজের সাংবাদিক আবু খালিদ, একাত্তর টেলিভিশনের বিশেষ প্রতিনিধি সুশান্ত সিনহা, বাংলাদেশ প্রতিদিনের সিনিয়র রিপোর্টার মানিক মুনতাসির, দ্য বিজনেস স্টান্ডার্ডের প্রধান প্রতিবেদক আব্বাস উদ্দিন নয়ন, সারাবাংলা ডটনেটের সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট এমদাদুল হক তুহিন, দ্য ডেইলি স্টারের স্টাফ রিপোর্টার সুকান্ত হালদার, দৈনিক খোলা কাগজের সিনিয়র রিপোর্টার মো. আলতাফ হোসেন, টাইমস অব বাংলাদেশের স্টাফ রিপোর্টার মো. আল আমিন, সংবাদের স্টাফ রিপোর্টার রেজাউল করিম, প্রতিদিনের সংবাদের স্টাফ রিপোর্টার মো. জাহিদুল ইসলাম ও মো. মেহেদী হাসান, ঢাকা মেইলের স্টাফ রিপোর্টার মো. আব্দুল হাকিম, ভোরের কাগজের সিনিয়র রিপোর্টার মরিয়ম সেজুতি, বাংলা ভিশন টেলিভিশনের সিনিয়র রিপোর্টার মামুন আব্দুল্লাহ, চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের রিপোর্টার তানজিলা আক্তার, আজকের পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার আসাদ্জ্জামান নূর ও মিম ওবায়দুল্লাহ, ঢাকা পোস্টের স্টাফ রিপোর্টার রাকিবুল হাসান তামিম ও বাংলাদেশ প্রতিদিনের রিপোর্টার মো. মিয়ামুন হোসেন।

