রুপসীবাংলা৭১ অন্যান্য ডেস্ক : সুখ-দুঃখ, উত্থান-পতন, জোয়ার-ভাটা, পাপ-পুণ্য—এই সবকিছু মানবজীবনেরই অংশ। কিন্তু একজন মুমিনের হৃদয় আল্লাহর প্রতি ঈমান, তাঁর অনুগ্রহের কৃতজ্ঞতা এবং তাকদিরের প্রতি সন্তুষ্টির মাধ্যমে স্থিরতা লাভ করে। দুঃখ-দুর্দশায় ভেঙে পড়ে না; হতাশ হয় না। কোরআন, হাদিস ও সাহাবাদের জীবন আমাদের শেখায়—ভুল করলে দ্রুত ফিরে আসা, কষ্টে ধৈর্য ধারণ করা এবং নিয়ামতে আল্লাহকে স্মরণ করা—এগুলো অন্তরের প্রকৃত জীবনকে জাগ্রত করে।
আল্লাহর নৈকট্যের পথে পরিচালিত করে। আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) বলেছেন : ‘মুমিন ব্যক্তি তার পাপকে এমনভাবে দেখে যেন সে একটি পাহাড়ের নিচে বসে আছে—ভয়ে থাকে, কখন পাহাড়টি যেন তার ওপর ধসে না পড়ে। কিন্তু পাপিষ্ঠ ব্যক্তি তার পাপকে দেখে নাকের ওপর বসা একটি মাছির মতো—সে হাত নেড়ে তা ঝেড়ে ফেলে দেয়।’
রাসুল (সা.) আরো বলেন : ‘আল্লাহ তাঁর বান্দার তাওবায় এমন আনন্দিত হন, যেমন সেই মানুষ আনন্দিত হয় যে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে হারানো বাহনটি ফিরে পেয়ে যায়।’ তিনি বর্ণনা করেন—এক ব্যক্তি তার বাহন নিয়ে নির্জন মরুভূমিতে বিশ্রামের জন্য নেমেছিল। তার বাহনের সঙ্গেই ছিল তার খাবারদাবার। কিছুক্ষণ ঘুমানোর পর জেগে দেখে, বাহনটি নেই। চারদিকে খুঁজেও না পেয়ে তাপ ও তৃষ্ণায় ক্লান্ত হয়ে যখন মৃত্যুর আশঙ্কা দেখা দিল, তখন সে ফিরে এসে আগের জায়গায় আবার শুয়ে পড়ল। ঘুম ভেঙে যখন মাথা তুলল, দেখল—তার হারানো বাহনটি ঠিক তার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৩০৮)
মানুষের অবস্থা এমনই—কখনো আনুগত্যে উর্ধ্বমুখী, কখনো অবাধ্যতায় নিম্নমুখী। কিন্তু প্রকৃত ধার্মিক সেই ব্যক্তি, যে ভুল করলে দ্রুত তাওবা করে ফিরে আসে এবং নিয়মিতই আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং বিপদ-আপদে আল্লাহর ওপর ভরসা করে কর্মচেষ্টা অব্যাহত রাখে। সহিহ বুখারিতে আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহর কসম! আমি প্রতিদিন ৭০ বারেরও বেশি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই এবং তাঁর কাছে তাওবা করি।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৩০৭)
চেষ্টা-প্রচেষ্টা সফলতা নিয়ে আসে।
আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেছেন : ‘যারা আমাদের পথে সংগ্রাম করে, আমরা অবশ্যই তাদের আমাদের পথে পরিচালিত করি। নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎকর্মশীলদের সঙ্গে আছেন।’
(সুরা : আনকাবুত, আয়াত : ৬৯)
সুতরাং আমাদের উচিত আল্লাহর রহমতে থেকে নিরাশ না হয়ে তাঁর ওপর পূর্ণ ভরসা রাখা এবং অন্তরের স্বভাবজাত বক্রতা থেকে তার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করা। কেননা যে স্বভাব ভুল করা ও স্খলনের প্রবণতা রাখে তা আল্লাহ তাআলাই সৃষ্টি করেছেন। হাদিসে এসেছে—হানজালা আল আসাদি (রা.), যিনি ছিলেন রাসুল (সা.)-এর লেখক, তিনি বলেন, একদিন আবু বকর (রা.) আমার সঙ্গে দেখা করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হানজালা, কেমন আছো?’ আমি বললাম, ‘হানজালা তো মুনাফিক হয়ে গেছে!’ তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘সুবহানাল্লাহ! তুমি কী বলছ?’ আমি বললাম, ‘আমরা যখন আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর সান্নিধ্যে থাকি, তিনি এমনভাবে জান্নাত-জাহান্নামের কথা স্মরণ করিয়ে দেন যেন আমরা তা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু তাঁর কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার পর, স্ত্রী-সন্তান ও দৈনন্দিন জীবনের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি—অনেক কিছুই ভুলে যাই।’ তখন আবু বকর (রা.) বললেন, ‘আল্লাহর কসম! আমরাও একই অবস্থা অনুভব করি।’ এরপর আমরা দুজন রাসুল (সা.)-এর কাছে গিয়ে বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসুল, হানজালা মনে করছে সে মুনাফিক হয়ে গেছে।’ নবী করিম (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, ‘বিষয়টি কী?’ আমি পুরো ঘটনাটি বর্ণনা করলাম। তখন রাসুল (সা.) বললেন, ‘যার হাতে আমার প্রাণ, তাঁর শপথ! যদি তোমরা আমার সঙ্গে থাকাকালীন অবস্থায় এবং আমার স্মরণে সর্বদা সেই অবস্থায় থাকতে, তাহলে ফেরেশতারা তোমাদের ঘুমের বিছানায় ও পথ চলাতেও তোমাদের সঙ্গে করমর্দন করত। কিন্তু হে হানজালা—কিছু সময় আল্লাহর স্মরণ ও ইবাদতের জন্য, আর কিছু সময় দুনিয়ার চাহিদা পূরণের জন্য।’ এ কথা তিনি তিনবার বললেন।
(সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৭৫০)
অতএব, আমাদের উচিত হবে আল্লাহ আমাদের যে অসংখ্য নিয়ামত দান করেছেন, সেগুলো নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করা। সেগুলো উপলব্ধি করা এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী আনন্দ থেকে আমরা যা হারাই কিংবা জীবনে যে কষ্ট, ক্লেশ ও পরীক্ষার মুখোমুখি হই—এসবের মধ্যে সওয়াব ও প্রতিদান খুঁজে নেওয়া জরুরি; কারণ দুনিয়ার প্রকৃতি এমনই—এটি স্বভাবতই পরীক্ষা ও দুঃখ-বেদনার স্থান। মহান আল্লাহ বলেন, ‘বলুন, হে আমার ঈমানদার বান্দারা! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় করো। যারা এ দুনিয়ায় সৎকর্ম করে তাদের জন্য রয়েছে মঙ্গল; আর আল্লাহর ভূমি তো প্রশস্ত। নিশ্চয়ই ধৈর্যশীলদের তাদের প্রতিফল হিসাব ছাড়াই দেওয়া হবে।’ (সুরা : ঝুমার, আয়াত : ১০)
তিনি আরো বলেন, ‘আর অবশ্যই আমরা তোমাদের পরীক্ষা করব ভয়, ক্ষুধা, ধন-সম্পদ, জীবন ও ফল-ফসলের ক্ষতির মাধ্যমে। আর তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও।’
(সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ১৫৫)
রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘মুমিনের ব্যাপার সত্যিই বিস্ময়কর! তার সব অবস্থাই তার জন্য কল্যাণময়। এবং এটি শুধু মুমিনের ক্ষেত্রেই ঘটে—যদি তার কাছে কোনো সুখ-সমৃদ্ধি আসে, সে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, আর তা তার জন্য কল্যাণ হয়ে যায়। আর যদি তার ওপর কোনো কষ্ট বা বিপদ আসে, সে ধৈর্য ধারণ করে, আর সেটিও তার জন্য কল্যাণের কারণ হয়ে যায়।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৯৯৯)
অতএব, আল্লাহর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস, তাঁর তাকদির ও পূর্বনির্ধারিত ভাগ্যের প্রতি সন্তুষ্টি—এসব মহান আল্লাহর অনন্য এক অনুগ্রহ। আল্লাহর প্রতি সুদৃঢ় ভরসা ও তাঁর রহমতের প্রতি উত্তম ধারণা মুমিনের হৃদয়ে প্রশান্তি এনে দেয়; জীবনের নানা পরীক্ষা, বিপদ ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় তাকে শক্তি ও স্থিরতা দান করে। আর মুমিনের জীবন দুঃখে ধৈর্য ও আনন্দে কৃতজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আলোকিত হয়। সুতরাং আমাদের উচিত আল্লাহর করুণায় নিরাশ না হয়ে, তাঁর প্রতি ভালো ধারণা পোষণ করা এবং তাঁর ওপর পূর্ণ ভরসা রাখা। যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে দৃঢ় থাকে, আল্লাহ তাঁর পথকে তার জন্য সহজ করে দেন—এটাই মুমিনের জীবনের প্রকৃত সফলতা।
রুপসীবাংলা৭১/এআর

