নিজস্ব প্রতিনিধি :মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা ভুইয়া।।
হযরত সূফী নূর মুহাম্মদ নিজামপুরী উনবিংশ শতাব্দীর একজন আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব সূফী সাধক বা পীর ছিলেন। উনার পূর্ব-পুরুষগণ ছিলেন গজনীর অধিবাসী ছিলেন। তিনি হযরত শহীদ সৈয়দ আহমদ বেরলভী (রহ.)’র তিনজন গাজীর অন্যতম। কথিত আছে নিজামপুরী গজনীর সুলতান পুত্র যুবরাজ বখতিয়ার কুতুজ এর ৭ম পুরুষের বংশধর। উলামা মাশায়েখ গণের কাছে তিনি ‘হাজি নিজামপুরী রহমতল্লাহি আলাইহি’ নামে পরিচিত। স্থানীয় জনসাধারণ তাকে ‘সুইসা’ বলে সম্বোধন করেন। শাহ সুফী নূর মুহাম্মদ নিজামপুরী রাহ. ছিলেন সমকালের এক শ্রেষ্ঠ বুযুর্গ সাধক এবং একইসঙ্গে নিবেদিত এক স্বাধীনতা-সংগ্রামী। উনবিংশ শতকের বাংলা-ভারত সর্বব্যাপী পরিচালিত জিহাদ আন্দোলনের একজন সশস্ত্র যোদ্ধা। আন্দোলনের প্রাণপুরুষ রায়বেরেলির সাইয়েদ আহমদ শহীদ (রহ.).-এর অন্যতম খলিফা এবং তাঁর প্রায় ১০ বছরের সংগ্রাম-সাধনার সঙ্গী। বালাকোট যুদ্ধের গাজী হজরত শাহ সুফি নূর মোহাম্মদ নিজামপুরী (রহ.) একজন নন্দিত সাধক পুরুষ। সমসাময়িক সমাজব্যবস্থায় রেসালাতে মোহাম্মদ (সা.)’র আদর্শ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন।
ইতিহাসবিদদের মতে তাঁর পূর্বপুরুষ ছিলেন ইরানী সূফীবংশোদ্ভুত। কালক্রমে তাঁরা আফগানিস্তানের গজনীতে সুলতান হন। গজনীর সুলতান বখতিয়ার কুতুব আলমের তিনি সপ্তম উত্তরপুরুষ। কারো কারো মতে, নূর মুহাম্মাদ নিজামপুরীর সঙ্গে হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.) এঁর বংশধর খালিদ বিন আবদুল্লাহর যোগসূত্র রয়েছে। উমাইয়া শাসনকালে জনাব আবদুল্লাহ ৬৬৪ সালে কাবুলের শাসনকর্তা ছিলেন। আবার কারো মতে, তিনি ইরানের সূফীকবি আবু মুহাম্মাদ মুসলেহ উদ্দীন বিন আবদিল্লাহ শিরাজীর (শেখ সাদী) বংশধর। আনওয়ারুন নাইয়্যিরাইন গ্রন্থের বর্ণনা মতে, শাহ সূফী নূর মুহাম্মাদ নিজামপুরী (রহ.) এর পূর্বপুরুষগণ গজনীর অধিবাসী ছিলেন। বখতিয়ার নামে গজনীর বাদশাহর একজন ছেলে ছিল। বাদশাহ তাকে কুতুবে আলম নামে ডাকতেন। বাল্যকালেই বখতিয়ার পিতৃহারা হন। মৃত্যুকালে তার পিতা তাকে তার এক মামার রক্ষণাবেক্ষণে রেখে যান এবং সমস্ত রাজত্ব ও ধন-দৌলত তাকে দিয়ে ওসীয়াত করেন; যদি ছেলে বড় হয়, তাহলে সমস্ত রাজত্ব ও ধন-দৌলত ছেলেকে সমর্পণ করবে। বখতিয়ার বড় হবার পর তার পিতৃসম্পতি মামার নিকট দাবি করলে তিনি তা দিতে অস্বীকার করেন। বরং তার উপর বিভিন্ন জুলুম, অত্যাচার করে তাকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়। বখতিয়ার নিরুপায় হয়ে নিজপুত্র ফিরোজ শাহ ও কন্যা মায়মুনা খাতুন এবং কতেক সম্ভ্রান্ত লোককে সাথে নিয়ে দেশ ত্যাগ করেন এবং দিল্লীর বাদশাহর নিকট উপস্থিত হন। দিল্লীর বাদশাহ রাজপুত্র হিসেবে বখতিয়ারকে খুব সম্মান করলেন। ফলে বখতিয়ারের ভাগ্য আলোকিত হয়ে গেল। বাদশাহ তার অপরিসীম বুদ্ধিমত্তায় মুগ্ধ হয়ে তাকে গৌড় নামক স্থানের বাদশাহী প্রদান করেন। ফিরোজ শাহ তার বোন মায়মুনা খাতুনকে সেনাপতি শুজা খাঁ এর সাথে বিবাহ দেন। ফলে মায়মুনাকে কেন্দ্র করে তাদের বংশ বিস্তার লাভ করে। মায়মুনা খাতুনের গর্ভে মিয়া মল্লিক জন্মগ্রহণ করেন। মিয়া মল্লিকের ঘরে ইবরাহীম জন্মগ্রহণ করেন। ইবরাহীমের ঘরে শেখ মুবারক ও শেখ বদ্দুহ জন্মগ্রহণ করেন। শেখ বদ্দুহ থেকে শেখ আমানুল্লাহ এবং শেখ আমানুল্লাহ থেকে শেখ নাসের মুহাম্মদ জন্মগ্রহণ করেন। তার ঘরে জন্মগ্রহণ করেন শেখ মুহাম্মদ ফানাহ (রহ.)। তিনিই শাহ সূফী নূর মুহাম্মাদ নিজামপুরী (রহ.) এর শ্রদ্ধেয় পিতা।
সূফী নূর মুহাম্মাদ নিজামপুরীর জন্মসন ও জন্মস্থান নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভিন্নতা দেখা যায়। অধিকাংশের মতে তিনি ১৭৯০ খ্রিষ্টাব্দে নোয়াখালী জেলার দান্দিরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা শেখ মুহাম্মাদ ফানাহ কুরআন ও হাদীস বিশারদ আলিমে দ্বীন ছিলেন। তাঁর কাছেই তিনি প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। এরপর নোয়াখালী জেলার বাহমনী এলাকার বিশিষ্ট আলিম ও বুযুর্গ আজিমপুর দায়রা শরীফের সূফী দায়েমের খলীফা শেখ জাহিদের তত্ত্বাবধানে শিক্ষা লাভ করেন। এরপর উচ্চ শিক্ষালাভের জন্য তিনি ঐতিহাসিক কলকাতা আলীয়া মাদরাসা গমন করেন। সেখান থেকে কুরআন, হাদীস, তাফসীর, ফিকহ, দর্শন ইত্যাদি বিষয়ে পান্ডিত্য অর্জন করেন। নূর মুহাম্মাদ আজমী তাঁর গ্রন্থে সূফী নূর মুহাম্মাদ নিজামপুরীকে চট্টগ্রামের মুহাদ্দিসীনে কিরামের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেন। কারো কারো মতে আলিয়া মাদরাসায় অধ্যয়ন সমাপ্তের পর তাঁকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করে মাদরাসা কর্তৃপক্ষ।
মাদরাসায় অধ্যয়নের পর তিনি আজিমপুর দায়রা শরীফের গদিনশিন সূফী সায়্যিদ লাক্বীত উল্লাহ (রহ.) এর কাছে নকশবন্দিয়া মুজাদ্দেদীয়া তরীকায় বায়আত গ্রহণ করে সূফী খেতাব লাভ করেন। এরপর হযরত রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে কলকাতায় গিয়ে সায়্যিদ আহমাদ শহীদ বেরলভী (রহ.) এর কাছে কাদিরিয়া, চিশতিয়া, নকশবন্দিয়া-মোজাদ্দেদীয়া ও মুহাম্মাদিয়া তরীকায় বায়আত গ্রহণ করেন। আইনায়ে ওয়াইসী গ্রন্থের ১০২ পৃষ্ঠায় বর্ণিত আছে, একদা সায়্যিদ আহমদ শহীদ তিনমাস কলকাতায় অবস্থান করেন। এ সময় তাঁর প্রভাবে হাজার হাজার মুসলমান সঠিক পথ প্রাপ্ত হয়। সিলেট, চট্টগ্রাম এর দূর দূরান্ত থেকেও অনেক মুসলমান আসে এবং তাঁর নিকট বায়আত গ্রহণ করে সত্যিকার ও ধার্মিক মুসলমান হয়। সায়্যিদ মুহাম্মদ আলী স্বীয় গ্রন্থ মাখযানে আহমদী গ্রন্থে লিখেছেন, প্রত্যেক এলাকা ও অঞ্চল থেকে অগণিত মুসলমান তাঁর নিকট উপস্থিত হন। শিরক-বিদআতে লিপ্ত মুসলমানগণ এবং নাফরমান ও পাপীগণ নিজেদের খারাপ কর্ম থেকে তাওবা করে খাঁটি মুমিনের দলভুক্ত হয়। সে সময় চট্টগ্রাম জেলার উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে মীরসরাই থানার অন্তর্গত মালিয়াইশ (মিঠানালা) গ্রামের জনৈক আলিম মাওলানা সূফী নূর মুহাম্মাদ নিজামপুরীকে স্বপ্নে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পক্ষ থেকে সুসংবাদ দেওয়া হয় যে, আমার আওলাদ সায়্যিদ আহমদ এসেছে, তুমি গিয়ে তাঁর হাতে বায়আত করো। অতঃপর সূফী নূর মুহাম্মাদ তাড়াতাড়ি কলকাতা আসলেন এবং নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুসংবাদ অনুসারে আমীরুল মুমিনীন হযরত সায়্যিদ আহমদ বেরলভী (রহ.) এর নিকট বায়আত গ্রহণ করেন।
স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে বায়আত গ্রহণ করার পর ১৮২১-১৮৩১ এই দশ বছরের দীর্ঘ সময় তিনি মুরশিদের সরাসরি সুহবতে ছিলেন। ১৮২১ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ জুলাই, ১২৩৬ হিজরী সনের ২০ শাওয়াল ৪৩০ জন সঙ্গীসহ সায়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (রহ.) কলকাতা থেকে হজব্রত পালনের উদ্দেশ্যে বায়তুল্লাহ শরীফ রওয়ানা হন। পথিমধ্যে আরো ৭০০ জন এই মুবারক কাফেলায় যুক্ত হয়। সূফী নূর মুহাম্মদ নিজামপুরী এই হজ্জের সফরে অন্যতম প্রধান সঙ্গী হিসেবে গমন করেন। জিহাদের সফরে সায়্যিদ আহমদ শহীদ (রহ.) তাবুর সন্নিকটেই নূর মুহাম্মাদ নিজামপুরী (রহ.) এর কামরায় থাকতেন। বায়আত গ্রহণের পরেই তিনি পীরের নির্দেশে রিয়াযতে নিমগ্ন হন। সায়্যিদ আহমদ শহীদ (রহ.) এর তালীম তাওয়াজ্জুহের ফলে দ্রুত তিনি কামালতের উচ্চ পর্যায়ে পৌঁছান এবং খিলাফত লাভ করেন। পীর ও মুরশিদ কর্তৃক তিনি দ্বীন ও তরীকা প্রচার এবং সালিকদের মধ্যে ফায়য প্রদানের নির্দেশ প্রাপ্ত হন। তিনি ও তাঁর পীরভাইদের একান্ত প্রচেষ্টায় সায়্যিদ আহমদ শহীদ (রহ.) এর কাফেলায় অসংখ্য সালিকের সমাবেশ ঘটতে থাকে তাঁরা সায়্যিদ আহমদ শহীদ (রহ.) এর কাছে বায়আত হয়ে সুন্নাতে নববীর অনুসরণের প্রতি তৎপর হয়ে ওঠে। এমনকি এসময় প্রতিদিন ৫০ থেকে ১০০ জন বিধর্মী মুসলমান হতো। মাখযানে আহমদীর লেখক বলেন, ঐ সময় জনসমাজে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয় যে, (দেখলে) তুমি বলতে এ যেন নবীর যুগ পুনর্জীবন লাভ করেছে।
তরীকতের বায়আতের পাশাপাশি সূফী নূর মুহাম্মদ তাঁর পীর মুরশিদ সায়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (র.) এর কাছে জিহাদেরও বায়আত গ্রহণ করেন। ১৮২৬ -১৮৩১ পর্যন্ত প্রায় ১৮টি ন্যায়সঙ্গত যুদ্ধে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ ও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। যেমন- আকুড়ার যুদ্ধ, নওশাহের যুদ্ধ, পাঞ্জতারের যুদ্ধ, মায়দার যুদ্ধ, শায়দুর যুদ্ধ, হাজারার যুদ্ধ, মাইয়ার যুদ্ধ ও ঐতিহাসিক বালাকোট যুদ্ধ। এছাড়া ফুলেড়া অভিযান, পেশোয়ার অভিযান ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। মায়দার যুদ্ধে শত্রুপক্ষ কামানের গোলা ছুড়তে শুরু করলে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে তখন সূফী নূর মুহাম্মাদ নিজামপুরী (র.) হাকীকতে মাকামে সাইফুল্লাহর ফায়য প্রয়োগ করেন ফলে নিজেদের সৈন্য রক্ষা ও শত্রুপক্ষকে ঘায়েল করার প্রথম পদক্ষেপ সফল হয়। এমনকি তিনি তাঁর নিজ হাত মুবারক দিয়ে কামানের গোলা হস্তগত করে অকার্যকর করে দেন। এর ফলশ্রুতিতে মুজাহিদ বাহিনী জয়লাভ করে। বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, কামান, গোলা, বারুদ ইত্যাদি হস্তগত হয়।৯
১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দে মাইয়ার যুদ্ধে ফজলুর রহমান বর্ধমানী শহীদ হন এবং মাওলানা আব্দুল হাকীম বাঙ্গালী ও সূফী নূর মুহাম্মাদ নিজামপুরী (রহ.) প্রমুখ জখমী হন। নওশাহের যুদ্ধে সূফী নূর মুহাম্মাদ নিজামপুরী অন্যতম সেনাপতির দায়িত্ব পালন করেন। প্রতিপক্ষের সহস্রাধিক সৈন্যের মুকাবিলা করেন। অসীম বীরত্ব ও সঠিক নেতৃত্ব সর্বোপরি আল্লাহ তাআলার গায়বী মদদে মুসলমানগণ উক্ত যুদ্ধে জয়লাভ করেন। এ সকল জিহাদে নূর মুহাম্মাদ নিজামপুরী বিশেষ নৈপুণ্য প্রদর্শন করেন, যুদ্ধের পূর্বে তিনি একটা রুমাল ঘুরিয়ে সেনাবাহিনীর চতুর্দিকে প্রদক্ষিণ করতেন এবং শত্রুপক্ষের তীর, বর্শা ইত্যাদি বিসমিল্লাহ বলে হাত দিয়ে ধরে ফেলতেন। অগণিত তীর, বর্শা ও বল্লমের আঘাতে তাঁর একহাত অবশেষে অবশ হয়ে যায় তবুও তিনি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করেন নি। রণজিৎ সিং এর বাহিনীর সাথে এক যুদ্ধের প্রাক্কালে রণজিতের প্রাসাদের অদূরে আমীরুল মুমিনীন সায়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (রহ.) তাঁর মুজাহিদ বাহিনী নিয়ে তাঁবু খাটান। নামাযের সময় হলে তিনি ঘোষণা দেন, “আজ ঐ ব্যক্তি আযান দিবেন যার (দীর্ঘ সময় উল্লেখপূর্বক) আসরের সুন্নাত নামায ছুটে যায়নি।” সেদিন সূফী নূর মুহাম্মদ নিজামপুরী আযান দেন। কথিত আছে, তাঁর আযানের সাথে সাথে রণজিত সিং এর রাজমুকুট খসে পড়ে এবং ঝড় শুরু হয়।
১২৪৬ হিজরীর ২৪ জিলকদ জুমুআ বার মুতাবিক ৬মে ১৮৩১ ইং সালে ঐতিহাসিক বালাকোট প্রান্তরে ইতিহাসখ্যাত বালাকোট যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে সূফী নূর মুহাম্মাদ নিজামপুরী অনবদ্য ভূমিকা রাখেন। এ যুদ্ধে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩০০ জন এবং শিখদের সংখ্যা ছিল ২০ হাজার। অপর্যাপ্ত রসদ ও প্রায় অস্ত্রবিহীন তিনশত মুসলিম মুজাহিদ বাহিনী বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ২০ হাজার শিখ সৈন্যকে বালাকোট প্রান্তর থেকে প্রায় ছয় মাইল দূরে হটিয়ে দেয়। কিন্তু কিছু পাঠানের বিশ্বাসঘাতকতায় অতর্কিত হামলায় মুজাহিদ বাহিনী বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে মুজাহিদে আযম সায়্যিদ আহমদ বেরলভী, শাহ ইসমাইল ও সায়্যিদ ওয়ারেস আলী প্রমুখ শাহাদাতের পেয়ালা পান করেন। এমন সঙ্কটকালে সূফী নূর মুহাম্মাদ নিজামপুরী সেনাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং তাঁর ইমানদীপ্ত ভাষণে মুজাহিদ বাহিনীর মনোবল ফিরে আসে। অতঃপর দুর্নিবার গতিতে যুদ্ধ চলতে থাকে নূর মুহাম্মাদ নিজামপুরী একাই প্রায় দুই হাজার শিখকে হতাহত করেন।
বালাকোট যুদ্ধের পর সূফী নূর মুহাম্মাদ কিছুকাল কলকাতায় অবস্থান করেন। একদা সূফী নূর মুহাম্মাদ গোলাম রহমান মসজিদে জামাআতের সহিত ইশার নামায পড়ার জন্য উপস্থিত হন। তখন ইংরেজ সরকারের একদল সিপাহী মসজিদটির চার পাশ ঘিরে ফেলে। পরিস্থিতি অনুধাবন করতে কারো অসুবিধা হলো না। সিপাহীরা অপেক্ষা করতে লাগল সূফী সাহেব নামায পড়ে বের হলেই গ্রেফতার করবে। অন্যান্য মুসল্লীগণ নামায শেষ করে স্ব স্ব গন্তব্যে ফিরে গেলেন। কেবলমাত্র সূফী নূর মুহাম্মাদ মসজিদের ভিতর আল্লাহর যিকরে মগ্ন। সিপাহীগণ ভাবল, তিনি আর কতক্ষণ মসজিদে থাকতে পারবেন, রাত্রি শেষে বাধ্য হয়েই তাকে বের হতে হবে এ ভেবে মসজিদ অবরোধ করে রাখল। তিনি যেন পালাতে না পারেন সেদিকে বিশেষ সতর্ক দৃষ্টি রাখা হলো। কিন্তু স্বয়ং আল্লাহ যাঁর নেগাহবান, তাঁর অনিষ্ট সাধন করা কি মানুষের সাধ্য? ভোর হওয়ার পর সিপাহীরা সূফী সাহেবকে ডাকতে লাগল, মসজিদের ভিতর তন্ন তন্ন করে সন্ধান করা হলো কিন্তু তাঁর নাম গন্ধও পাওয়া গেল না। মহান আল্লাহ পাকের অপার করুণা ও অসীম কুদরতে সূফী নূর মুহাম্মাদ অলৌকিকভাবে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
এরপর তিনি ফিরে এসে নিজামপুর পরগনার মলিয়াইশে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেন। এবং বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে তাঁর পীর মুর্শিদের প্রতিষ্ঠিত তরীকা-ই-মুহাম্মদীয়ার বার্তা প্রচারে নিজেকে নিয়োজিত করেন। দ্রুততম সময়ে যদিও মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা সহজসাধ্য ছিল না, তাই লোকজনের মনোযোগ আকর্ষণ এবং ইসলাম ধর্মের মৌলিক নীতি বিষয়ে লোকজনকে প্রশিক্ষণ দিতে তিনি তাঁর মসজিদ সংলগ্ন একটি খানকা প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর বক্তব্য শুনতে এবং নিজেদেরকে তরীকায়ে মুহাম্মদিয়ার বিধি অনুযায়ী সজ্জিত করতে এই খানকায় বিপুল সংখ্যক লোক একত্রিত হতো। তিনি মুজাররাদ (চিরকুমার) ছিলেন। বাংলা অঞ্চলে সায়্যিদ আহমদ শহীদ (রহ.) এর দুইজন বিশিষ্ট খলীফা মাওলানা শাহ কারামত আলী জৌনপুরী (রহ.) ও সূফী নূর মুহাম্মাদ নিজামপুরী (রহ.) এর সিলসিলাহের মাধ্যমে বিকাশ লাভ করে। উক্ত দুই মুবারক সিলসিলাহ’র মাধ্যমে দ্বীনের প্রচার প্রসারে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জিত হয়। বিশাল সংখ্যক মানুষের ইসলাম গ্রহণ, ইসলামী তাহযীব, তামাদ্দুন ও সুন্নাতের ব্যাপক প্রচলন এবং অসংখ্য মসজিদ, মাদরাসা, খানকা, ইয়াতীমখানা, হিফযখানা, কিতাবখানাসহ বিভিন্ন দ্বীনী ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করে এই সিলসিলাহদ্বয় দ্বীন ও দেশের কল্যাণে অসামান্য অবদান রাখে।
সূফী নূর মুহাম্মদ নিজামপুরী (রহ.) এর খলীফাদের মধ্যে সূফী ফতেহ আলী ওয়াইসি বর্ধমানী (রহ.) ছিলেন প্রধান। তিনি কামালিয়াতের উচ্চ পর্যায়ের অধিকারী ছিলেন। তাঁর পিতা সায়্যিদ ওয়ারেস আলী বালাকোট যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন। তিনি রুহানীভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অহরহ যিয়ারত পেতেন বিধায় তাঁকে ‘রাসূলে নুমা’ বলা হয়। তিনি উচ্চ পর্যায়ের আশিকে রাসূল ছিলেন। তরীকতের ইমামগণের কাছ থেকে তিনি রূহানী তালীম তারবিয়াতপ্রাপ্ত হয়েছিলেন বিধায় তাঁকে ওয়াইসী বলা হয়। সূফী নূর মুহাম্মাদ নিজামপুরী (রহ.) এর অন্যান্য খলীফাদের মধ্যে চট্টগ্রামের শাহ আহমদুল্লাহ (র.) খান বাহাদুর হামীদুল্লাহ খান (রহ.), মাওলানা আকরাম আলী নিজামপুরী (রহ.) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
সূফী নূর মুহাম্মাদ নিজামপুরীকে তাঁর ইন্তিকালের আগ পর্যন্ত তরীকায়ে মুহাম্মাদিয়া প্রচারে নিয়োজিত রেখেছিল। ইতিহাসবিদ গোলাম রাসূল মেহের বলেন, সূফী নূর মুহাম্মাদ নিজামপুরী (রহ.) অত্যান্ত নিষ্ঠাবান, রিয়ামুক্ত, দ্বীনদার ও পরহেজগার বুযুর্গ ছিলেন। সূফী নূর মুহাম্মাদ নিজামপুরী (রহ.) এর পবিত্র জীবন যেন আসহাবে সুফফার নূরে জ্যোতির্ময়। তাঁর জীবনালেখ্য আমাদের সাহাবা কিরামের সেই জীবনাচারকেই যেন পুনর্পাঠ করায়। এই মহান মুহাদ্দিস ও বীর মুজাহিদ ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দের ১ নভেম্বর, ১৩ কার্তিক ১২৬৬ বঙ্গাব্দ, ১২৭৫ হিজরীর রবীউল আউয়াল মাসের ২৪ তারিখ সোমবারে ইহধাম ত্যাগ করেন। চট্টগ্রামের মিরসরাইতে তাঁর প্রতিষ্ঠিত মসজিদের পাশেই তিনি শায়িত আছেন।
তিনি অছিয়ত করে যান মৃত্যুর পর যেন কবরের ওপর ঘর বা গম্বুজ না করে। কবর নিয়ে যেন অযথা ব্যয় না করে এবং কবরকে ঘিরে শরিয়তবিরোধী যেন কোনো কাজ না করা হয়। তার মৃত্যুর পর অদ্যাবধি তার অছিয়ত বাস্তবায়ন রয়েছে। কবরের চার পাশে দেয়াল দেয়া হলেও ছাদ কিংবা গম্বুজ দেয়া হয়নি। প্রত্যেক বছর বাংলা বর্ষের ১৩ কার্তিক ইছালে ছওয়াবের উদ্দেশ্যে মাহফিল করলেও শরিয়তবিরোধী কোনো কাজ করা হয় না। আলহাজ হাফেজ সৈয়দ আবুল বাশার মোহাম্মদ বশির উদ্দিন সাহেব রহ:-এর একান্ত প্রচেষ্টা ও পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৬৫ সালের ১৩ কার্তিক ইসালে সওয়াব মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৭৪ সাল থেকে নিয়মিত এবং ১৯৭৬ সাল থেকে মাহফিলটি ব্যাপকতা লাভ করে। ১৯৮০ সাল থেকে বৃহদাকারে স্থানীয় জনগণের উদ্যোগে বার্ষিক ইসালে সওয়াব মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়।
উল্লেখিত মহাপুরুষ শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক নেতা,পীর-আউলিয়া ছিলেন না, তাঁরা দেশপ্রেমিক স্বাধীনতা সংগ্রামীও ছিলেন। তাঁদের এ দিকটার কথা দেশবাসী ভুলে গেছে। সূফী নুর মুহম্মদ নিজামপুরী (রহ.)’র পীর ও মোর্শেদ হযরত শহীদ সায়্যিদ আহমদ বেরলভী (রহ.) তাঁর জন্য দোয়া করেছিলেন এভাবে, “হে আল্লাহ! আপনি নূর মুহাম্মদ’র পরকালের ঘরকে (কবরকে) খুশবুতে ভরপুরে রাখুন।” অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, নিজামপুরী (রহ.)’র মাজারে আজো খুশবু মাখা ঐশ্বরিক সুঘ্রাণ পাওয়া যায়। এ মহান অলিয়ে কামেল আজ শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে আছেন চট্টগ্রামের মীরসরাই মিঠানালা ইউনিয়নে। হে আল্লাহ! আপনার নেয়ামতপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের পথে ও মতে জীবন গড়ার তৌফিক দান করুন।

