রুপসীবাংলা৭১ অন্যান্য ডেস্ক : রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন চল্লিশে পদার্পণ করলেন, তখন দীর্ঘদিনের চিন্তাশীলতা, গভীর বিচার-বিবেচনা ও অন্তর্দৃষ্টি যা জনসাধারণের সঙ্গে তাঁর মধ্যেকার দূরত্বের এক প্রাচীর তৈরি করেছিল, তা ধীরে ধীরে প্রকাশিত হতে লাগল। ক্রমে ক্রমে নির্জনতা তাঁর অন্তরের এক প্রিয় অভ্যাস হয়ে উঠল। খাদ্য ও পানীয় সঙ্গে নিয়ে তিনি মক্কা নগরী থেকে প্রায় দুই মাইল দূরে অবস্থিত হেরা পর্বতের গুহায় চলে যেতে শুরু করলেন। যেখানে তিনি নির্জনে সময় কাটাতেন।
গুহাটি ছিল ক্ষুদ্র, দৈর্ঘ্যে প্রায় চার গজ এবং প্রস্থে পৌনে দুই গজ, নিচের অংশ তেমন গভীর ছিল না। পাহাড়ের উপরের অংশের সঙ্গে মিলিত হয়ে গুহাটি এমন একটি আকৃতি ধারণ করেছিল যা দেখে মনে হতো যেন শোভাযাত্রার আরোহী সুসজ্জিত অশ্বের মৃদু ঢেউয়ে মিশে গেছে।
পুরো রমজান মাস রাসুলুল্লাহ (সা.) হেরা গুহায় অবস্থান করে গভীর ধ্যানমগ্ন থাকলেন। তিনি দৃশ্যমান ও দৈনন্দিন জীবনের জটিলতার অন্তরালে যে মহাশক্তি প্রতিটি মুহূর্তে সবকিছুকে জীবন ও শক্তি জাগিয়ে রেখেছে, সেই মহামহীয়ান ও অদ্বিতীয় সত্তার প্রতি তাঁর অন্তর নিবদ্ধ করতেন।
স্বগোত্রীয় লোকদের অর্থহীন বহুত্ববাদী বিশ্বাস ও পৌত্তলিক ধ্যানধারণা তাঁর অন্তরে তীব্র বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করত, কিন্তু তখন তাঁর জন্য কোনো নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ পথ খোলা ছিল না।
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নির্জন-প্রিয়তা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তাআলার সুপরিকল্পিত ব্যবস্থার অংশ। আল্লাহ তাঁকে প্রস্তুত করছিলেন একটি মহৎ কাজের জন্য। প্রস্তুত করছিলেন এমন এক আত্মা যাকে কবুল করা হবে নবুওয়য়াতের মতো আসমানী দায়িত্ব সম্পাদনের জন্য।
সেই আত্মা পথভ্রষ্ট ও অধঃপতিত মানুষদের সঠিক পথ দেখাবে। সমাজ জীবনের সমস্ত ব্যস্ততা, দৈনন্দিন ঝামেলা ও দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত হয়ে নির্জন ধ্যানের মাধ্যমে তিনি আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
সে প্রেক্ষিতেই যখন মহানবী (সা.)-এর চল্লিশতম বছর পূর্ণ হলো—যে বয়স মানব জীবনের পূর্ণতা আসে। আর নবুওয়তের জন্য সর্বোত্তম ও পরিপক্ক হিসেবে বিবেচিত হলো। তখন নবুওয়তের কিছু সূক্ষ্ম লক্ষণ প্রকাশিত হতে শুরু করল।
প্রাথমিকভাবে এসব লক্ষণ স্বপ্নের মাধ্যমে প্রকাশ পেত, যা সর্বদা সত্য প্রতিফলন ঘটাত, সুবহে সাদেকের মতো। এভাবেই ছয় মাসের মধ্য দিয়ে নবীজির জীবন নবুওয়তের প্রারম্ভিক প্রস্তুতিতে এগিয়ে চলল।
তিনি ধ্যানমগ্ন হয়ে হেরা গুহায় দিনরাত অতিবাহিত করতেন। মাসের পর মাস এভাবে সময় কেটে যাচ্ছিল। সেই নির্জন হেরা গুহার ধ্যানমগ্ন অবস্থায় তিনি আধ্যাত্মিক জগতে পরিভ্রমণ করতেন, সকল অস্তিত্বের অন্তরালে লুক্কায়িত অদৃশ্য রহস্যের প্রতি তাঁর চিত্ত নিবদ্ধ হতো। এতে তিনি এমন গভীর অন্তর্দৃষ্টি অর্জন করতেন যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ আসার মুহূর্তে তিনি তা অবিলম্বে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হতেন।
অতপর দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে নবী করিম (সা.)-এর জীবনচক্রে সেই মুহূর্তটি আসে যখন আল্লাহর নির্দেশমাফিক জিবরাঈল (আ.) প্রথমবারের মতো তাঁর নিকট আগমন করেন। হেরা গুহায় অবস্থানকালে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় জিবরাঈল (আ) তাঁর নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন, ‘اقْرَأْ’। নবী করিম (সা.) বিনীতভাবে জবাব দিলেন; ‘পড়ার অভ্যাস আমার নেই।’ জিবরাঈল (আ.) তাঁকে দৃঢ়ভাবে আলিঙ্গন করলেন এবং বললেন, ‘পড়ো।’ তিনবার এভাবে ঘটার পর নবীজির অন্তরে কোরআনের প্রথম আয়াতের মহিমান্বিত জ্যোতি প্রকাশ পায়:
اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ خَلَقَ الْإِنسَانَ مِنْ عَلَقٍ اقْرَأْ وَرَبُّكَ الْأَكْرَمُ
অর্থ “সেই প্রভুর নামে পড় যিনি মানুষকে রক্ত পিন্ড থেকে সৃষ্টি করেছেন। পড়, আর তোমার প্রভু দয়ালু ও উদার।”
আর রাহীকুল মাখতুমের বিবরণ মতে- এ ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল রমাযান মাসে ২১ তারিখ মঙ্গলবার দিবাগত রাত্রে। খ্রীষ্টিয় হিসাব অনুযায়ী দিনটি ছিল ৬১০ খ্রীষ্টাব্দের ১০ই আগষ্ট। চান্দ্রমাসের হিসাব অনুযায়ী নাবী কারীম (ﷺ)-এর বয়স ছিল চল্লিশ বছর ছয় মাস বার দিন এব সৌর হিসাব অনুযায়ী ছিল ৩৯ বছর ৩ মাস ২০ দিন।
ওহী প্রাপ্তির পর মহানবী (সা.) অস্থির হয়ে খাদিজা (রা.)-এর নিকট প্রত্যাবর্তন করলেন। খাদিজা (রা.) তাঁকে আশ্বস্ত করে বললেন, ‘ভয় করো না। আল্লাহ কখনো আপনাকে অপমান করবেন না। ধৈর্য ধরুন, আত্মীয়-স্বজন ও সমাজের প্রতি সদ্ব্যবহার বজায় রাখুন, অভাবীদের সাহায্য করুন, অতিথিদের আদর করুন।’
এরপর খাদিজা (রা) নবীজিকে তাঁর চাচাত ভাই ওয়ারাকা বিন নাওফালের নিকট নিয়ে গেলেন। ওয়ারাকা অবাক হয়ে বললেন, ‘ইনিই সেই সত্তা যিনি মুসা (আ.)-এর নিকট আগমন করেছিলেন। কিন্তু হায়! তোমার স্বজাতি তোমার উপর জলুম চালাবে।’ ওরাকার মুখ থেকে এ কথা শ্রবণের পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘একী! ওরা আমাকে দেশ থেকে বহিস্কার করবে? নবীজির প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, তারা আপনাকে দেশ থেকে বহিস্কার করবে। অতীতে সত্যের বার্তা বাহকদের উপর এধরনের জুলুম ঘটেছে এবং এটিই ইতিহাসের বাস্তবতা।’
এর পর কিছু দিন ওহী সাময়িকভাবে বন্ধ হওয়ার সময় মহানবী (সা.) গভীর চিন্তায় ও বিচলিত বোধ করতে শুরু করলেন। তবে জিবরাঈল (আ.) তাঁর কাছে উপস্থিত হয়ে শান্তির বার্তা দিতেন। এই বিরতির সময়কাল সম্পর্কে আর রাহীখুল মাখতুমের ভাষ্য হলো- প্রথম ওহী অবতীর্ণ হয়েছিল ২১ রামাযান। ওহী বন্ধ থাকার সময়কাল ছিল মাত্র ১০ দিন। অতঃপর নবুওয়াতের প্রথম বছর শাওয়াল মাসের প্রথম দিবস শুক্রবার সকালে পুনরায় ওহী অবতীর্ণ হয়। যা নবীজির জন্য ঈদের মতো আনন্দময় মুহূর্ত বয়ে আনে।
এই সময়ের নির্জন ধ্যান, অন্তর্দৃষ্টি ও আধ্যাত্মিক প্রস্তুতি নবীজিকে এমন এক মানসিক ও আত্মিক শক্তি প্রদান করেছিল, যা তাঁকে মানবজাতির জন্য মহামূল্যবান দিশা প্রদানের জন্য প্রস্তুত করেছিল। হেরা গুহার সেই নির্জনতা, খাদিজাহ (রা.)-এর সহানুভূতি, ও জিবরাঈল (আ.)-এর নির্দেশ—সব মিলিয়ে নবীজির জীবনের মহাপ্রারম্ভিক অধ্যায়কে এক অনন্য আধ্যাত্মিক ও সাহিত্যঘন রূপ দিয়েছে।
-(আর রাহীকুল মাখতুম অবলম্বনে)

