নিজস্ব প্রতিবেদকঃসামাজিক সুরক্ষা প্রতিটি নাগরিকের অধিকার।বাংলাদেশের সংবিধানে এ ব্যাপারে সুস্পাভাবে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।দেশের ক্রমবর্ধমান বক্ষে জনসংখ্যাকে সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার আওতায় আনার লক্ষ্যে ২৪ জানুয়ারী ২০২০ সংসদে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন- ২০২৩ পাস হয়। সিমটি প্রবীণ জনগোষ্ঠীকে বেকারত্ব, রোগ, অক্ষমতা, নির্ভরশীলতা বা নার্ধক্যজনিত জটিলতা বা চরম দারিদ্র্যের মোকাবেলায় খাপ খাইয়ে নিতে সহায়তা করবে। আইনে সর্বমোট ৩২টি ধারা আছে।সর্বজনীন পেনশন স্কিম সর্বজনীন পেনশন স্কিম হল এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে বক্ষেরা তাদের দৈনন্দিন ব্যয় নির্বাহের জন্য একটি মাসিক ভাতা পাবেন।যারা এই সিমের আওতায় আসার যোগ্য জাতীয় পরিচয়পত্রের ভিত্তিতে ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী সকল নাগরিক এই সুবিধার জন্য যোগ্য হবেন।
• প্রতিটি নাগরিকের জন্য পৃথক পেনশন হিসাব থাকবে। • সরকারি ও আধা-সরকারি বা স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মচারীগণ সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার আখতা বহির্ভূত থাকবেন। • প্রবাসী বাংলাদেশীরা এই সুবিধা পাবেন
সার্বজনীন পেনশনে অংশ নিতে শর্তাবলী
একজন নাগরিককে কমপক্ষে ১০ বছরের জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ প্রিমিয়াম/চাঁদা দিতে হবে। দাতার বয়স ৬০ বছর পূর্ণ হলে তার জমানো তহবিল ও মুনাফার বিপরীতে পেনশন প্রদান করা হবে।• ৬০ বছর পূর্ণ করার পর, চাঁদাপাতা ব্যক্তি মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত পেনশন পাবেন।• বিশেষ বিবেচনায় ৫০ বছরের বেশি বয়সী নাগরিকরাও পেনশন কিনে অংশ নিতে পারবেন। পেনশন গ্রহীতা জীবিত থাকলে আজীবন পেনশন পাবেন। তবে মারা গেলে তারা নমিনি ৭৫ বছর বয়স পর্যন্ত পেনশন পাবেন।

চাঁদা এবং চাঁদা জমাদানের প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি
• চাঁদা মূলত মাসিক বা ত্রৈমাসিক বা বার্ষিক ভিত্তিতে প্রদান করা যেতে পারে।• অংশগ্রহণকারীরা অগ্রিম চাঁদা না দিতে পারবেন।
• জমাকৃত চাঁদা একবারে উত্তোলন করা যাবে না। টাকা উত্তোলন করতে চাইে ঋণ হিসেবে সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ উত্তোলন করতে পারবেন।
• পরবর্তীতে নির্ধারিত ফি-এর পাশাপাশি ঋণের পরিমাণ পরিশোধ করতে হবে। স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য পেনশন তহবিলের চাঁদার একটি অংশ সরকার অনুদান হিসেবে প্রদান করবে।
সুবিধাভোগী মারা গেলে যারা সুবিধা পাবে
• একজন সুবিধাভোগী ৭৫ বছর বয়সের পূর্বে মারা গেলে তার নমিনী মৃত ব্যক্তির বয়স ৭৫ বছর পর্যন্ত অবশিষ্ট সময়ের জন্য মাসিক পেনশন পাবেন। • কমপক্ষে ১০ বছরের প্রিমিয়াম দেওয়ার পূর্বে সুবিধাভোগীর মৃত্যু হলে নমিনি জমাকৃত পরিমাণ এবং সেই পরিমাণের বিপরীতে অর্জিত মুনাফা পাবেন।
জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ
একজন নির্বাহী চেয়ারম্যান ও চারজন সদস্য সমন্বয়ে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ গঠন করা হবে, যা হবে একটি সংবিধিবন্ধ সংস্থা। তহবিলে জমা করা টাকা নির্ধারিত নীতিমালা অনুযায়ী বিনিয়োগ করবে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ।
গভর্নিং বোর্ড (পরিচালনা পর্ষদ)
পেনশন ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে অর্থমন্ত্রীকে চেয়ারম্যান করে ১৬ সদস্যের একটি গভর্নিং বোর্ড গঠন করা হবে। তবে গভর্নিং বোর্ড প্রয়োজনে যে কোনো ব্যক্তিকে গভর্নিং বোর্ডের সদস্য হিসাবে কো-অপ্ট করতে পারবে বা সভায় অংশগ্রহণের জন্য আমাণ জানাতে পারবে। সদস্যবৃন্দ
(১) মাননীয় মন্ত্রী, অর্থ মন্ত্রণালয় (যিনি ইহার চেয়ারম্যানও হবেন।
(২) গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক,
(৩) সচিব, অর্থ বিভা
(৪) সচিব, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ
(৫) চেয়ারম্যান, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, (৬) সচিব, সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়
(৭) সচিব, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়:
(৮) সচিব, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মানায়
(৯) সচিব, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়
(১০) সচিব, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ:
(১১) সচিব, প্রধানমন্ত্রী কার্য
(১২) চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন:
(১৩) সভাপতি, ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (এফবিসিসিআই)।
(১৪) সভাপতি, বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশন।(১৫) সভপতি, বাংলাদেশ উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (বিডব্লিউসিসিআই);
(১৬) নির্বাহী চেয়ারম্যান, যিনি ইহার সদস্য সচিবও হইবেন।
পেনশন স্কিমের সীমাবদ্ধতা
সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যেখানে কোনো অবদান ছাড়া চাকুরী শেষে পেনশন পান সেখানে বেসরকারি চাকুরীজীবী, শ্রমিক বা অন্যান্য নাগরিকগণ কেনো চাঁদার বিনিময়ে পেনশন পাবেন।
পেনশন ব্যবস্থা অনেকটা গতানুগতিক ইন্সুরেন্স স্কিমের মতো মনে হচ্ছে। একজন চাঁদা দিলে, টাকা জমা রাখলে তার আলোকে তার জমা করা টাকাটা মুনাফাসহ ফেরত দেয়া হবে।
সরকার একজন নাগরিককে অধিকার হিসেবে কর্মহীন হওয়ার পর সেবাদানের স্বীকৃতি হিসেবে তার ভরণ-
পোষণের জন্য অবদান রাখবে। সেটা যতদিন পূরণ না হবে ততদিন পর্যন্ত এটাকে পেনশন বলা যায় না। ফিমে অংশগ্রহণ করতে হলে পূর্বের সংশ্লিষ্ট সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সুবিধা ভোগ করতে পারবেন না। যেখানে পেনশন পাবে ৬০ বছর পরে সেখানে বিদ্যমান সুবিধা থেকে সে বঞ্চিত হচ্ছে এবং পেনশনের জন্য দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হবে।
এদেশের জনসংখ্যার বেশিরভাগ অংশ সামজীবী। পেনশন আইনে তাদের জন্য বিশেষ বিধান থাকা উচিত ছিলো. কিন্তু সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইনে শ্রমজীবী মানুষের জন্য কোনো সুস্পষ্ট বিধান নেই। > সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইনের গভর্নিং বোর্ডে (পরিচালনা পর্যদ) সরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী সংগঠন। এবং নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। কিন্তু শ্রমিক সংগঠন এবং শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা
সংগঠনসমূহের প্রতিনিধি নেই।
সর্বজনীন পেনশন আইন অনুসারে ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সের সরকারী কর্মচারী ব্যতিত সকল নাগরিক কমপক্ষে ১০ বছর ধারাবাহিক ভাবে নির্ধারীত হারে প্রিমিয়াম পরিশোধ সাপেক্ষে ৬০ বছর অতিক্রমের পরে পেনশন পাওয়ার অধিকারী হবেন। অথচ দেশের ৯০ শতাংশের বেশী শ্রমজীবী মানুষের ধারাবাহিক ভাবে চাকরির সুযোগ না থাকায় নিয়মিত আয়ের সুযোগ থাকে না, স্বল্প মজুরির কারণে তাদের প্রাত্যহিক জীবনযাপন ব্যায় নির্বাহ করায় কষ্টসাধ্য, তেমন কোনো সঞ্চয় থাকেনা, তাদের পক্ষে ১০ বছর যাবৎ নিয়মিত প্রিমিয়াম পরিশোধ করা হবে দুঃসাধ।
> বিশেষ বিবেচনায় ৫০ বছরে বেশি বয়সী নাগরিকগণও স্কিমে অংশগ্রহণ করতে পারেন, মূল আইনে না থাকায় এবং এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট নির্দেশনা না থাকায় এতে সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে।
>> টানা ৩ মাস চাদা দিতে ব্যর্থ হলে পেনশন স্কিম স্থগিত হবে। এক্ষেত্রে প্রথম মাস বাদে পরবর্তী প্রতি দিনের জন্য চাঁদার ১ শতাংশ হারে জরিমানা দিয়ে ক্ষিম সচল করতে পারবে। এখানে জরিমানার পরিমাণ অনেক বেশি। বাংলাদেশের মানুষের গড় আৰু ৭৪ বছর এবং সুস্থ আৰু ৬৪ বছর। তবে পেনশন স্কিমে অংশগ্রহণের সর্বোচ্চ বয়স ৫০ বছর নির্ধারণ করা হয়েছে। যার কারণে ৫১ থেকে ৬৪ বছর বয়সী প্রায় দেড় লাখ মানুষ পেনশন স্কিমে অংশগ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবেন।
পরিচালনা পর্ষদের সভায় যে কোনো ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ জানানো যেতে পারে। কাকে আমরা জানানো হবে তা স্পষ্ট নয় এবং তার জন্য মাপকাঠি কী হবে তারও কোনো সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা নেই।
বিধি ৮ (২) অনুযায়ী চাদাদাতা এ বছর নিখোঁজ থাকলে উক্ত স্কিম স্থগিত হবে এবং ৭ বছর পরেও যদি চাঁদা নাতা ফিরে না আসে তবে পেনশনের প্রাপ্যতা অর্জিত হওয়া সাপেক্ষে তাকে নির্ঘোষ পেনশনার বলে গণ্য করা হবে। এখানে এই ৭ বছরে ভুক্তভোগী পরিবার কোনো সাহায্য পাবে কিনা সেটার কোনো নির্দেশনা নেই।
বিধি ৮ (৩) অনুযায়ী পেনশনার তার বয়স (৭৫) বছর হবার পূর্বে নিখোঁজ হলে তার নিখোঁজ হবার ৭ বছর পরে তাহা নমিনি পেনশন এর অর্থ বুঝে পাবে। এখানে ৭ বছর দীর্ঘ সময় হয়ে গেছে।
বিএসপিএএনের দাবিসমূহ/সুপারিশমালা * স্কিমে অংশগ্রহণ করতে হলে পূর্বের সংশ্লিষ্ট সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সুবিধা ভোগ করতে পারবেন না। এই শর্ত বাতিল করা উচিত।
পরিচালনা পর্ষদে সুশীল সমাজ এবং বাংলাদেশের শ্রমিক সংগঠনসমূহের একজন প্রতিনিধিকে অন্তর্ভূক্ত করলে শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হবে।
স্বল্প আয়ের মানুষের সংজ্ঞায় মাসিক আয় ৫ হাজার টাকার কথা বলা হয়েছে। এটা বর্তমান মুদ্রাস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে কমপক্ষে ১০ হাজার টাকা করা উচিত।
• শ্রমজীবী মানুষের জন্য টানা ১০ বছর চাঁদা প্রদানের বিষয়টি শিথিল করা উচিত।
■ সরকারি-বেসরকারি সকল চাকুরিজীবির জন্য পেনশনের ক্ষেত্রে সাম্য নিশ্চিত করা উচিত।
– সর্বজনীন করতে হলে সরকারের অবদানের অংশ বাড়ানো উচিত।
– সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইনের গভর্নিং বোর্ডে (পরিচালনা পর্ষদ) শ্রমিক সংগঠন এবং শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা সংগঠনসমূহের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা উচিত। বিএসপিএন থেকে একজন এবং শ্রমিক সংগঠনসমূহের একজন প্রতিনিধি পরিচালনা পর্ষদে অন্তভূক্তির দাবি জানাই।
• পেনশনের স্কিমের মেয়াদ ৫০ বছর বয়স থেকে বাড়িয়ে ৬৪ বছর করা উচিত।
– পরিচালনা পর্ষদের সভায় যে কোনো ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ জানানোর জায়গায় আমন্ত্রিত ব্যক্তির ক্যাটাগরি সুনির্দিষ্ট করা উচিত।
• চাঁদাদাতা নিখোঁজ হলে নমিনির পেনশনের এর অর্থ বুঝে পাবার মেয়াদ ৭ বছর এর স্থলে ৩ থেকে ৪ বছর করা উচিত।
উল্লেখ্য : বাংলাদেশ সোশ্যাল প্রোটেকশন অ্যাডভোকেসি নেটওয়ার্ক (বিএসপিএএন) ১৮টি বেসরকারি সংস্থা ও শ্রমিক সংগঠনের নেটওয়ার্ক যা ২০১৭ সাল থেকে সামাজিক সুরক্ষার জন্য পলিসি অ্যাডভোকেসি করে আসছে।