রুপসীবাংলা ৭১
নিজস্ব প্রতিনিধিঃ বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের প্রধান সমস্যা দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি। যার ফলে আয়ের পরিমাণ না বাড়লেও বেড়েছে ব্যয়ের পরিমাণ। তার উপর বিদ্যুতের ঘাটতি চরম আকার ধারণ করেছে। দেখা দিয়েছে মূল্যস্ফীতি। মূল্যস্ফীতি বলতে যেমন ধরুন গত মাসে একটি পণ্যের দাম ছিল ১০০ টাকা কিন্তু চলতি মাসে সেই পণ্যটি কিনেছেন ১৩০ টাকায়। বাড়তি ৩০ টাকা মূল্যস্ফীতি ইংরেজিতে যাকে বলে ইনফ্লেশন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যের ভিত্তিতে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় প্রতিমাসের মূল্যস্ফীতি জনসম্মুক্ষে প্রকাশ করে থাকেন। চলতি বছরে মে মাসে ৭ দশমিক ৪২ শতাংশ, জুন মাসে ৭দশমিক ৫৬ শতাংশ, জুলাই মাসে ৭দলমিক ৪৮ শতাংশ। যা ১৯ জুলাই ২০২২ ইং প্রকাশ করা হয়। কিন্তু অক্টোবর মাস শেষ হয়ে গেলেও গত দুই মাসের তালিকা প্রকাশ করা হয়নি। সবুজ আন্দোলন তথ্য ও গবেষণা পরিষদ একটি পরিসংখ্যান চালিয়ে গত দুই মাসে ১০০ জন সাধারণ জনগনের এবং দোকানিদের সাথে কথা বলে ডাটা তৈরীর মাধ্যমে একটি ধারণা পাওয়ার চেষ্টা করেছে।
সেখানে দেখা গেছে দেশে চলতি মাসে ১১ শতাংশের বেশি মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। আজ ২৯ অক্টোবর সকালে দারুস-সালাম আর্কের্ডের ৭ম তলায় পরিবেশবাদী সংগঠন সবুজ আন্দোলনের উদ্যোগে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি- বিদ্যুতের ঘাটতি, নবায়নযোগ্য জ্বালানীর ব্যবহার নিশ্চিত করতে করণীয় শীর্ষক আলোচনা সভার আয়োজন করে। সবুজ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালন পরিষদের চেয়ারম্যান বাপ্পি সরদার এর সভাপতিত্বে বিশেষজ্ঞ আলাচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিআইআইএসএস এর গবেষণা পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. মাহফুজ কবীর, পরিবেশ বিজ্ঞানী বিএআরডির পরিচালক ড. ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল হামিদ, সেন্টার ফর গ্লোবাল এনভাইরণমেন্ট এন্ড ডেভেলপমেন্ট এর নির্বাহী আব্দুল ওহাব, আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কৃষিভিত্তিক গবেষণা সংস্থা প্রত্যাশার বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল মামুন, এসএমই ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আলি জামান।
আন্তর্জাতিক বাজারে পন্যের অস্থিতিশীলতা অন্যতম প্রধান কারণ। আমরা আপনাদেরকে আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যস্ফীতির একটি চিত্র তুলে ধরছি। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে ৮ শতাংশ, চীনে ৩ শতাংশ,ইংল্যান্ডে ৬ শতাংশ, ইউরোপের ১৯ টি রাষ্ট্রে ৫.৫০ শতাংশ, জার্মানিতে প্রায় ৫ শতাংশ, জাপানে ২ শতাংশের কাছাকাছি, পাকিস্তানের ১৫ শতাংশের বেশি, পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতে প্রায় ৬ শতাংশ। ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধের ফলে তেল উৎপাদনকারী সকল রাষ্ট্র অধিক মুনাফার জন্য চাহিদার থেকে কম তেল উৎপাদন করছে যাতে করে আগামীতে অধিক মুনাফা করতে পারে।মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণসমূহ চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন কম, সরবরাহ ব্যবস্থায় সিন্ডিকেট প্রথা, পরিবহন সংকট (সড়ক, নৌ ও আকাশ পথে), শ্রমিক ঘাটতি, জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি, চীনের খাদ্যবাজারে অস্থিতিশীলতা, উন্নত রাষ্ট্রগুলোর আগ্রাসি মনোভাব।বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে ৪২ থেকে ৫১ শতাংশ, ডিজেল লিটারে ২৯ টাকা, অকটেন ৪৬ টাকা, পেট্রোল ৪৪ টাকা। পেঁয়াজ ৩৫ থেকে ৫০ টাকা, ডিম ১১০ থেকে ১৫০ টাকা, সকল মাছের উপর ৩০ টাকার অধিক, চাউল ৬০ টাকা থেকে ৭০ টাকা। এক্ষেত্রে সকল পণ্যের উপরে বিগত দুই মাসে দাম বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় শতকরা ২০ ভাগের বেশি।

বিদ্যুৎ ঘাটতির ক্ষেত্রে সরকার বিভিন্ন কারণ তুলে ধরলেও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন কুইক রেন্টাল পদ্ধতি ব্যবহারের কারণে আজকের এই দুরবস্থা। সরকার নির্বাচনী ওয়াদা অনুযায়ী ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছানোর জন্য কুইক রেন্টাল পদ্ধতি ব্যবহার করেছে কিন্তু পুরাতন বিদ্যুৎ কেন্দ্র সচল রাখা, নতুন নতুন গ্যাস ক্ষেত্রের সন্ধান না করা, নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ যেমন রামপাল, রূপপুর ও পায়রা বন্দরের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে সময় ক্ষেপণ করার ফলে বিদ্যুতের এই ঘাটতি তৈরি হয়েছে। বর্তমানে সারা বাংলাদেশ ৩৫ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা থাকলেও সরকার ২৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে রেকর্ড সৃষ্টি করলেও বর্তমানে তা কমে এসে দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার মেগাওয়াটে। ঢাকা শহরে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি ও ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি দায়িত্ব পালন করছে। যদিও সরকার বলেছিল বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য একটি সিডিউল তৈরি করে সারাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে কিন্তু এই পদ্ধতি সম্পূর্ণ বিকল হয়ে পড়েছে। গ্যাসের অভাবে কিছু প্লান্ট বন্ধ রয়েছে গ্রিড বিপর্যয়ের ফলে যা চালু করা সম্ভব হয়নি। যদিও আমরা কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর যার ফলশ্রুতিতে বিদ্যুতের এই ঘাটতি মোকাবেলার জন্য দ্রুত নবায়নযোগ্য জ্বালানীর ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এর জন্য দরকার প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পে দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে রিজার্ভের অবস্থা খুবই করুন। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ও টেলিভিশনে ইতোমধ্যে আমরা দেখতে পেয়েছি সরকারের সোলার প্যানেল উৎপাদন ও বরাদ্দে সীমাহীন দুর্নীতি ও অনিয়মের চিত্র। নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনের জন্য খোলা মাঠে সোলার সিস্টেম তৈরি, ঢেউ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন, বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব।
সবুজ আন্দোলনের পক্ষ থেকে বেশ কিছু প্রস্তাবনা তুলে ধরা হয়- মূল্যস্ফীতি রোধে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে” স্বাধীন কমিশন” গঠন করা পাশাপাশি দীর্ঘস্থায়ী কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নীতিমালা প্রণয়ন, আমানত ও ঋণ সরবরাহের ক্ষেত্রে সুদের হার মূল্যস্ফীতি দিয়ে ঠিক করা এবং মুদ্রা বাজার স্থিতিশীল রাখতে মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার, কুইক রেন্টাল পদ্ধতি থেকে বের হয়ে এসে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ জোরদার করা এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানীর ব্যবহার নিশ্চিতে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ, নির্মাণাধীন বিদ্যুৎ কেন্দ্র গুলো দ্রুত উৎপাদনে নিতে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ এবং প্রকল্প ব্যয় কমিয়ে সকল দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া, সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ এবং স্থলে গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধি, মজুত, নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের জন্য অর্থ বরাদ্দ করে গবেষণা জোরদার করা, সরকার ও সাধারণ জনগণকে তেল-গ্যাস বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হতে হবে এবং বাজারো অস্থিতিশীল করার জন্য সিন্ডিকেট মুক্ত বাজার পদ্ধতি গড়ে তোলা, সারা দেশের জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহে কারচুপি মনিটরিং এ ডিজিটাল মনিটরিং সিস্টেম চালু করতে সিসি ক্যামেরার ব্যবস্থা করতে হবে এবং ক্রয়ের ক্ষেত্রে সকল প্রকার দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে।এসময় বক্তারা বলেন, বাজারের সিন্ডিকেট কে মোকাবেলা করার জন্য সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে পাশাপাশি নবায়নযোগ্য জ্বালানীর ব্যবহার বাড়াতে চলমান প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং কারিগরী সহযোগিতার জন্য উন্নত রাষ্ট্রের সহযোগিতা নিতে হবে। ক্ষতিগ্রস্থ রাষ্ট্র হিসেবে দায়ী রাষ্ট্রগুলো বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক জলবায়ু তহবিল দিতে সরকারি তৎপরতা চালিয়ে যেতে হবে।অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সবুজ আন্দোলনের পরিচালক অভিনেতা উদয় খান। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদের অর্থ সম্পাদক আলমগীর হোসেন পলাশ, কেন্দ্রীয় সদস্য জামিল আহমেদ, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সহ-সভাপতি সেলিনা চৌধুরী, ছাত্র পরিষদের সহ-সভাপতি এম আলম রাইন প্রমুখ।