ইতিহাস ধ্বংসের ইতিহাস : অতীত থেকে বর্তমান—অরুণ কুমার গোস্বামী

0
135

‘ছেলেবেলা থেকে যে নড়াইলকে দেখে এসেছি, যে নড়াইলকে নিয়ে আমরা গর্ব করি, সেই নড়াইলের সঙ্গে এই নড়াইলকে আমি মেলাতে পারছি না। . . .এই ঘটনায় আমি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। আমরা নিজেরা এভাবে বিভক্ত হয়ে পড়ব, আমি এটা কখনোই ভাবতে পারি না। এই নড়াইলকে তো আমি চিনি না। . . . এই দেশ আমাদের, এই মাটি আমাদের । এই মাটি যেন কারো জন্য অনিরাপদ না হয়, ৭১-এর মতো বুক পেতে সবাইকে আগলে রাখতে হবে আমাদের এক মূহুর্তও সেই আদর্শ আমাদের ভুলে গেলে চলবে না।’ গত ১৫ জুলাই ২০২২ তারিখে নড়াইলে ঘটে
যাওয়া সাম্প্রদায়িক হামলা সম্পর্কে সেখানকার সংসদ সদস্য, বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা তাঁর ভেরিফায়েড ফেসবুকে আক্রমনের পরদিন ১৬ জুলাই ২০২২ তারিখে দেয়া পোস্টে এসব কথা লিখেন। স্পষ্টতই বাংলাদেশ ক্রিকেট দলে নড়াইল এক্সপ্রেস নামে খ্যাত মাশরাফির এই কথা থেকে বোঝা যাচ্ছে একটি বিশেষ গোষ্ঠী সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধ্বংস করতে চাচ্ছে। আর তাতে তিনি গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ইতিহাস ধ্বংসের এই ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। তবে একদিকে যেমন ইতিহাস ধ্বংস করার উদাহরণ আছে পাশাপাশি ইতিহাস-ঐতিহ্য রক্ষার ব্যাপারেও প্রতিবাদী হওয়ার নজিরও ইতিহাসে আছে। ১৯৫৫ সালের ২৫ আগস্ট পাকিস্তান কন্সটিটিউয়েন্ট এসেম্বলিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘পূর্ব বাংলার’ পরিবর্তে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ করার বিরোধিতা করে বাংলার ‘ঐতিহ্য’ ও ‘উত্তরাধিকার’ রক্ষার কথা জোরালোভাবে উত্থাপন করেছিলেন। ‘বাংলা’ শব্দের মধ্যেই যে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের চিহ্ন আছে বঙ্গবন্ধুর কথায় তা স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। এই ইতিহাস ও ঐতিহ্যের বিভিন্ন দিক আছে। বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী বাংলার মানুষের মধ্যে আবহমান কাল ধরে বিরাজিত সুপ্রতিবেশীসুলভ সম্পর্কও বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অংশ। আর একবিংশ শতাব্দীর স্বাধীন বাংলাদেশে বিশেষত ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু মানুষদের জীবন, সম্পত্তি ও স্বাধীনতার ওপর হামলার যেসব ঘটনা ঘটে চলেছে তা সেই ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। মাশরাফি সেই ব্যাপারেই তাঁর উদ্বেগের কথা প্রকাশ করেছেন।
স্মরণাতীত কাল থেকে পাশাপাশি সুপ্রতিবেশী হিসাবে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী একটি জনগোষ্ঠী যখন বসবাস করতে থাকে তখন তাদের পরস্পরের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাবের বীজ ক্রমান্বয়ে শিকড় গাড়তে থাকে। সেই শিকড়ই ইতিহাস। সভ্য মানুষ এই ইতিহাস সংরক্ষণ করতে চায়। আর অসভ্যরা চায় সম্প্রীতির সেই ইতিহাস ধ্বংস করতে। আর এভাবেই ‘ইতিহাস ধ্বংসের ইতিহাস’ আখ্যায়িকাটির সূচনা। ইতিহাস জানা বর্তমান ও ভবিষ্যতের এগিয়ে চলার জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। বিখ্যাত ইংরেজ ঔপন্যাসিক টেরি প্র্যাচেট (১৯৪৮-২০১৫) বলছেন,আমরা কোথা থেকে এসেছি তা জানা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, কারণ কোথা থেকে আমরা এসেছি তা যদি আমরা না জানি তাহলে আমরা কোথায় যাচ্ছি তা জানা যাবে না। এবং কোথায় যাবো তা যদি না জানি, তাহলে সম্ভবত আমরা ভুল দিকে যাচ্ছি।’ বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর যে সাম্প্রদায়িক হামলা হচ্ছে তা মূলত ভুল দিকে এগিয়ে যাওয়ারই চরম উদাহরণ।
এই পরিস্থিতিতে প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন হচ্ছে, ‘বাঙালির সমাজ ও রাজনৈতিক জীবনে এমন বিভক্তিমূলক পরিস্থিতি কবে বা কখন থেকে শুরু হলো ?’ সাম্প্রদায়িক হামলা চিরতরে বন্ধ করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের নিমিত্তে এই প্রশ্নটির উত্তর অনুসন্ধান জরুরী।

আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামও অনেক আগেই প্রশ্ন করেছিলেন, ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোনজন?’কবি নিশ্চয়ই তখনও এধরনের বিভক্তি, হিংসা ও ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্তির উদাহরণ লক্ষ্য করেছিলেন। ভারতীয় উপমহাদেশে এধরনের বিভক্তিমূলক সাম্প্রদায়িকতা মূলত রাজনৈতিক কারণে হয়েছে।
সপ্তদশ শতাব্দীর মোগল সম্রাট সাজাহানের জ্যেষ্ঠ পুত্র দারাশিকোহ্ধসঢ়; একজন বিদগ্ধ পন্ডিত ছিলেন। মাত্র ১৮ বছর বয়সে দারাশিকো সম্রাট সাজাহানের উত্তরাধিকার নিযুক্ত হয়েছিলেন। তিনি বিভিন্ন ধর্মের বিশ্বাসের মানুষের মধ্যে ঐক্যবদ্ধতা স্থাপনের চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর পূর্বে সম্রাট আকবর এখানে এক জাতিতত্ত¡ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলেন। এর বিপরীতে রাজনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য স সাজাহানের আর এক পুত্র আওরঙ্গজেব ধর্মকে ব্যবহারকরে, বড়ভাই দারাশিকো কে হত্যার মাধ্যমে জনগণকে ধর্মীয় পরিচয়ে বিভক্ত করেছিলেন।
রাজনৈতিক ক্ষমতা সুসংহত করার লক্ষ্যে আওরঙ্গজেব কর্তৃক সম্প্রীতি ধ্বংস করার কর্মকান্ড ছিল খুবই মর্মান্তিক ও বেদনাদায়ক! আওরঙ্গজেব ১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভারত শাসন করেছিলেন। নিজ পুত্র (আওরঙ্গজেবের) হাতে বন্দী থাকা অবস্থায় পিতা সম্রাট সাজাহান যখন একদা মধ্যাহ্নের খাবার খাচ্ছিলেন তখন তরবারির আঘাতে বিকৃত ও ক্ষতবিক্ষত তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র দারাশিকোহ্ধসঢ়;-র কাটা মাথা আওরঙ্গজেব উপহার হিসাবে তাঁর (পিতার) কাছে পাঠিয়েছিলেন!ক্ষমতায় এসে আওরঙ্গজেব ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ধর্ম পালনের ওপর জিজিয়া কর আরোপ করেছিলেন।এখন যখন স্বাধীন বাংলাদেশে মসজিদসহ সব ধর্মীয় উপাসনালয়ে বিনামূল্যে সরকার বিদ্যুতের ব্যবস্থাসহ যাবতীয় সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করে থাকেন, সেই তুলনায় শুধু ধর্মীয় সংখ্যালঘু
হওয়ার জন্য আওরঙ্গজেব যে আলাদাভাবে ‘কর’ দেয়ার নিয়ম চালু করেছিলেন তা’ নি:সন্দেহে বৈষম্যমূলক! যা জনগণের মধ্যে বিভক্তির সূত্রপাত ঘটায়।


১৮১৯ থেকে ১৮২৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বোম্বের গভর্নর মাউন্টস্টোন এলফিনস্টোন ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দে প্রথম প্রকাশিত তাঁর বই ‘আওরঙ্গজেব’-এ লিখেছেন মুঘল স¤্রাট আওরঙ্গজেব তাঁর রাজ্য শাসন সংক্রান্ত কর্মকান্ডের রেকর্ড সংরক্ষণ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। আওরঙ্গজেবের শাসনামলে রাজ্যের যাবতীয় ঘটনাবলীর ধারা কেবল মাত্র ব্যবসা-সংক্রান্ত চিঠিপত্রে এবং বেসরকারী ব্যক্তি বিশেষের দ্বারা গোপনে রক্ষিত লেখায় পাওয়া সম্ভব। এলফিনস্টোনের মতে আওরঙ্গজেবের ইতিহাস সম্পর্কিত নিষেধাজ্ঞা ছিল অধিকতর স্থায়ী। যদিও কোন কোন ইতিহাসবিদের মতে অন্যান্য শাসকদের শাসনসংক্রান্ত ইতিহাস সম্পর্কে আওরঙ্গজেব বেশ কৌতুহলি ছিলেন। কিন্তু নিজের
রাজ্য শাসন সংক্রান্ত রেকর্ড রাখার ব্যাপারে তিনি নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। এর কারণ কী এই যে শাসন ক্ষমতা দখল ও পরিচালনায় তিনি যে নোংড়ামি ও নৃশংসতার নজির আওরঙ্গজেব স্থাপন করেছিলেন তা যেন প্রকাশ না হয় সে ব্যাপারে আগে থেকেই তিনি সতর্ক হয়েছিলেন? রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্মের অপ-ব্যবহারকারী মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেব কর্তৃক অনুসৃতবৈষম্যমূলক নীতির সম্পূর্ণ বিপরীতে, হিন্দু মুসলিম ধর্মীয় বিভেদ লুপ্ত করে কীভাবে এক বাঙালি জাতি তৈরি করতে চাওয়া সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানসহ সব বাঙালি তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের উদাহরণ তুলে ধরে বলেছিলেন, ‘আমি অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তার ভিত্তিতে বাংলাদেশে বাঙালি নামক একটি জাতি গড়ে তুলব।’ বঙ্গবন্ধুর এই চেতনার বহি:প্রকাশ দেখা যায় বর্তমান সরকারের কর্মকান্ডে। ১লা বৈশাখে বাংলা নববর্ষের মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করা, সরকারি কর্মচারীদের জন্য বৈশাখী ভাতা চালু করা প্রভৃতি বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার কর্তৃক বাঙালি সংস্কৃতি শক্তিশালীকরণের জন্য গৃহীত পদক্ষেপগুলোর মধ্যে অন্যতম। এর পাশাপাশি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়কে অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু সংখ্যালঘুদের জীবন, সম্পত্তি ও স্বাধীনতার ওপর সাম্প্রদায়িক আক্রমনের এই প্রবণতা এদেশকে কোন্ধসঢ়;দিকে নিয়ে যাচ্ছে ? এভাবে চলতে চলতে একদিন দেখা যাবে বঙ্গবন্ধু যে বাংলাদেশ চেয়েছিলেন, মুক্তিযুদ্ধ যে বাংলাদেশের কথা চিন্তা করে সংগঠিত ও সংঘটিত হয়েছিল সেই বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গিয়েছে। বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য ধ্বংসমুখী এই যাত্রা চিরতরে বন্ধ করা প্রয়োজন। আর এটি করার জন্য উদ্ভাবনী ও সময়োপযোগী কিছু কিছু সংবিধানসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ এখন সময়ের প্রয়োজনে পরিণত হয়েছে।

সংখ্যালঘু কমিশন গঠন, সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন এবং সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন এধরনেরই পদক্ষেপের অংশ। বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পরিচালিত ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু-বান্ধব সরকার এব্যাপারে সতর্ক আছেন বলেই পর্যবেক্ষকমহলের ধারণা।

*প্রফেসর ড. অরুণ কুমার গোস্বামী,

সাবেক ডিন, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ,

জগন্নাথ বিশ্বিবিদ্যালয়

এবং আহব্বায়ক, বাংলাদেশ শিক্ষক ঐক্য পরিষদ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে