ভরাট নদি পুনরায় খনন করতে হবে…….. বাপা

0
100

নিজস্ব প্রতিনিধি:- বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)র উদ্যোগে আজ ২১ জুন, ২০২২ মঙ্গলবার সকাল ১০.০০টায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (নসরুল হামিদ মিলনায়তন), সেগুনবাগিচা, ঢাকায় “আকস্মিক বন্যায় সিলেটে মানবিক বিপর্যয়ঃ কারণ ও করণীয়”-শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। বাপা’র সহ-সভাপতি ও বেনের প্রতিষ্ঠাতা ড. নজরুল ইসলাম এর সভাপতিত্বে এবং বাপা’র সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল-এর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন বেনের বৈশ্বিক সমন্বয়ক, বাপা কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও যুক্তরাষ্ট্রের লক হ্যাভেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ড. মো. খালেকুজ্জামান। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত থেকে সিলেট ও সুনামগঞ্জ অঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন সারি নদী বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি আব্দুল হাই আল হাদী।

এতে উপস্থিত থেকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বক্তব্য রাখেন বাপা’র যুগ্ম সম্পাদক শারমীন মুরশিদ ও মিহির বিস্বাশ। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাপা’র যুগ্ম সম্পাদক অধ্যাপক আহমেদ কামরুজ্জমান মজুমদার ,বাপা’র নদী ও জলাশয় বিষয়ক কমিটির সদস্য সচিব ড. হালিম দাদ খান, বাপা নির্বাহী কমিটির সদস্য ইবনুল সাঈদ রানা, যুব বাপা’র সদস্য সচিব এডভোকেট রাওমান স্মিতা। এছাড়াও অনুষ্ঠানে ভাচর্‚য়ালী যুক্ত ছিলেন বাপা’র সহ-সভাপতি অধ্যাপক নূর মোহাম্মদ তালুকদার, কোষাধ্যক্ষ মহিদুল হক খান, বাপা নির্বাহী কমিটির সদস্য ফরিদুল ইসলাম, আব্দুল
করিম কিম ও অধ্যাপক রবিন্দ্রনাথ চৌধুরী প্রমূখ।সভাপতির বক্তব্যে ড. নজরুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ মূলত একটি বদ্বীপ অঞ্চল।এখানে উন্নয়ন পরিকল্পনা করতে গেলে এদেশের প্রকৃতির চরিত্র বিবেচনায় নিয়েই পরিকল্পনা করতে হবে। নদ-নদীকে প্লাবনভূমিতে আসতে দিবে না এ ধারাতে গত সাত দশক ধরে বাঁধ নির্মানের নিয়ম চালু রেখেছে এদেশের সরকার।

কিন্তু নিয়ম হচ্ছে নদীকে কোনভাবেই বাঁধ দিয়ে আটকে রাখা যায় না। এ বেষ্টনী পদ্ধতি পরিহার করে উম্মুক্ত পদ্ধতি চালু করার দাবী জানান তিনি। নদীতে বন্যার পানি আসবেই এটাই স্বাভাবিক কিন্তু ওপরে বাঁদ দিয়ে পানি আটকে রাখা যাবে না। আমরা মনে করি সিলেট সুনামগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতির একটি মূল কারণ এ বাঁধ বা সড়ক নির্মান। আমরা জানি সিলেট অঞ্চলে প্রায় ১২ হাজার কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে যা মূলত অত্রএলাকার স্থায়ী বন্যা সৃষ্টির কারণ। এই বন্যার ফলে প্রকৃতিই বলে দিল কোনভাবেই যত্রতত্র রাস্তা-বাঁধ নির্মাণ সঠিক সিদ্ধান্ত না। তিনি আরো বলেন এলাকার পানি যেন অবাধে চলাচল করতে পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে। কোনোভাবেই নদীতে অপরিকল্পিত রাস্তা নির্মাণ করা যাবেনা। ভূ- প্রকৃতির চরিত্র তথ্য-উপাত্ত ও গবেষণা ব্যতিত কোনভাবেই সড়ক নির্মাণ করা যাবেনা। নদী ব্যবস্থাপনার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করার আহবান জানান তিনি। প্লাবনভূমিকে ধ্বংস করে উন্নয়ন করলে এধরনের ধ্বংসযজ্ঞ বার বার দেখতে হবে বলেও তিনি সতর্ক করেন।

তিনি প্রয়োজনে অপটিমাইজেশন এক্সারসাইজ-এর মাধ্যমে সড়ক নির্মানের মন্তব্য করেন। মূল বক্তব্যে ড. মো. খালেকুজ্জামান বলেন, শুধু জুন মাসেই মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে ৪০৮১ মিঃমিঃ বৃষ্টিপাত হয়েছে। একই সময়কালে সুনামগঞ্জেও রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়েছে। যেহেতু বিরামহীনভাবে এই বৃষ্টিপাতের ঘটনা ঘটেছে, তাই মেঘনা অববাহিকা অঞ্চলের মাটি পানিতে পরিপূর্ণ হয়ে থাকার কারনে সমস্ত বৃষ্টির পানি ভূউপরিস্থ প্রবাহে রূপান্তরিত হয়ে নদী-নালা-খাল-বিল প্লাবিত করে বন্যার সৃষ্টি করেছে। এ বছরের আগেও ২০১৭ সালে অকাল বন্যায় হাওরের জানমাল,গবাদিপশু, হাঁস-মুরগী এবং মাছের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। তাছাড়া ২০১৮ এবং ২০১৯ সালেও হাওরের বিভিন্ন অংশে বন্যা হয়েছিল। উপরোক্ত তথ্য থেকে একটি জিনিষ স্পষ্ট হয়েছে যে অধুনাকালে বন্যার মাত্রা, তীব্রতা এবং স্থায়িত্বকাল বেড়ে গিয়েছে। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি স্পষ্টতই জলবায়ূ পরিবর্তনের প্রাক্কালনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

বন্যার অন্তর্নিহিত কারণ হিসাবে বৈশ্বিক, আন্তঃদেশীয়, এবং আভ্যন্তরীন কারণকেই দায়ী করা যায়। বৈশ্বিক কারণ
হচ্ছে জলবায়ূ পরিবর্তনের সাথে সম্পর্কিত। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে আমাদের অঞ্চলে বর্ষাকালে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ এবং বন্যার মাত্রা যে বেড়ে যাবে তা বিজ্ঞানীরা আগেই প্রাক্কলন করেছিলেন। জলবায়ূ পরিবর্তনের ফলে সমূদ্র-পৃষ্ঠ ক্রমেই উপরে উঠে আসছে, যার ফলে সমূদ্রগামী নদীর প্রবাহ ধীরগতি সম্পন্ন হয়ে পড়ছে এবং নদীগুলি আগের মত কার্যকরভাবে পানি নিষ্কাশন করতে পারছেনা।নদীর ধীর গতির কারণে হাওর অঞ্চলে বন্যা প্রলম্বিত হচ্ছে। আন্তঃদেশীয় কারণ হিসাবে উজানের দেশ ভারত কর্তৃক একতরফাভাবে মেঘনা অববাহিকার প্রত্যেকটি নদীর পানিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রন, বনাঞ্চল উজার করা এবং কয়লা ও অন্যান্য খনিজ পদার্থ উত্তোলনের মাধ্যমে প্রচুর পলি এবং রাসায়নিক দূষন সৃষ্টি করার কথা উল্যেখযোগ্য।

মেঘনা অববাহিকার ৫৭% এলাকাই ভারতে অবস্থিত। ডক্টর খালেকুজ্জামান বলেন রাস্তার পরিবর্তে উড়ালসেতু করতে হবে যেন নদীর সাধারন প্রবাহ বাধাগ্রস্থ না হয়, সঠিক পন্থায় নদী খনন করতে হবে এবং আন্ত:নদীগুলোর
বিষয়ে প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোচনা করতে হবে। তিনি বলেন বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য মূলত তিনটি কারণ দায়ী- বৈশ্বিক, আন্তদেশীয় এবং অভ্যন্তরীণ।সংবাদ সম্মেলন থেকে নিম্মোক্ত সুপারিশসমূহ তুলে ধরা হয়:
১. নদীর প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গী পরিবর্তন করতে হবে। বাংলাদেশের কৃষ্টি, শিল্প-সাহিত্য, সভ্যতা, এবং ব-দ্বীপ গঠনে নদীর ভূমিকা হৃদঙ্গম করে নদী ব্যবস্থাপনা নির্ধারণ করতে হবে।২. নদীর প্রাকৃতিক কার্যপ্রক্রিয়া আমলে নিয়ে নদীর প্লাবনভূমি নদীর প্রবাহের জন্য বরাদ্দ রেখে, উন্নয়ন কর্মকান্ডের নামে নদীর ধংস প্রক্রিয়া রহিত করে, জলবায়ূ প্রবর্তনহেতু সৃষ্ট বাড়তি প্রবাহ ধারণের সক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্যে নদী বক্ষ থেকে বাড়তি পলি ক্রমান্বয়ে ড্রেজিং এর মাধ্যমে সরাতে হবে।

৩. নদীর স্বাভাবিক গতি ফিরিয়ে আনতে হবে।৪. প্রত্যেকটি নদীর উতৎ থেকে মুখ পর্যন্ত অববাহিকা ভিত্তিক সমন্বিত পানি-পলি ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে সমস্ত অংশীজনের স্বার্থরক্ষাকারী দীর্ঘমেয়াদী চুক্তি সম্পাদন করতে হবে।
৫. জাতিসংঘের পানি প্রবাহ আইন কার্যকর করে, সেই আইনের আলোকে চুক্তি করতে হবে এবং গ্যারান্টি ক্লজ সহ সেই চুক্তির বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।৬. সমস্ত আন্ত:দেশীয় নদীর পানি-পলি ব্যবস্থাপনাকে রাষ্ট্রীয় কুটনীতির
কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করতে হবে। নদী বাঁচলেই বাংলাদেশ বাঁচবে এই সত্যটি সবার হৃদয়ে ধারণ করতে হবে এবং সেই মোতাবেক সমস্ত কর্মকান্ড পরিচালনা করতে হবে।৭. হাওড়ে রাস্তার পরিবর্তে উড়াল সেতু নির্মাণ করতে হবে।
৮. অফটিমাইজেশন এক্সারসাইজ-এর মাধ্যমে সড়ক নির্মানের পরিকল্পনা করতে হবে। =৯. নদীতে বাঁধ পদ্ধতি পরিহার করে উম্মুক্ত পদ্ধতি চালু করা শরীফ জামিল বলেন ঢাকার চারপাশের নদ-নদীগুলো কে খালে পরিণত করা হয়েছে।

এ অবস্থা দেখে তিনি ঢাকার পরিস্থিতি সিলেট-চট্টগ্রাম এর মত হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন। অব্যবস্থাপনার কারণে সকল হাওরের পানি কমে যাচ্ছে শুকনো মৌসুমে ভারত সরকার একতরফাভাবে নদীগুলোকে ব্যবহার করছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।শারমিন মুরশিদ বলেন, কোন কোন সময় সরকার জলবায়ু পরিবর্তন শব্দটি ব্যবহার করে দায় এড়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু দেশের এ বন্যা পরিস্থিতির কারণ কোনোভাবেই সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এড়াতে পারে না। এজন্য সরকারের কিছু অপরিকল্পিত প্রকল্প ও পরিকল্পনাই দায়ী। তিনি অপরিকল্পিত রাস্তা ব্রীজ ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণকে হাওর অঞ্চলের বন্যার কারণ বলেও উল্লেখ করেন।সিলেট সারি বাঁচাও নদী আন্দোলনের সভাপতি আব্দুল হাই আল হাদি বলেন সিলেট এলাকায় সর্বপ্রথম ‘কাপনা’ নামক একটি নদী উল্টা দিকে প্রবাহিত হতে দেখা যায়।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে