নিজস্ব প্রতিনিধি:-ডায়েরিয়া সংকট মোকাবেলা ও সুপেয় পানি সরবরাহ নিশ্চিতকরণের দাবিতে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) ও বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিকের যৌথ উদ্যোগে আজ ১৮ এপ্রিল জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে সকাল ১১ টায় এক নাগরিক সংলাপ বারসিকের পরিচালক রোমাইসা সামাদের সভাপত্বি ও গবেষক পাভেল পার্থের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত হয়। নাগরিক সংলাপে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ও বক্তব্য প্রদান পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খান, পবা’র সাধারণ সম্পাদক ও পরিবেশ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক প্রকৌশলী মো: আব্দুস সোবহান, বাপার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মিহির বিশ^াস, আওয়ামী বাস্তহারা লীগের সাধারণ সম্পাদক লায়ন রাশেদ হাওলাদার, নগর গবেষক মো: জাহাঙ্গীর আলম, বারসিকের সমন্বয়ক ফেরদৌস আহমেদ উজ্জল, বস্তিবাসী অধিকার সুরক্ষা কমিটির সভাপ্রধান হোসনে আরা বেগম রাফেজা, মুক্তিযোদ্ধা সিদ্দিক আলী,পুরান ঢাকা নাগরিক উদ্যোগের সভাপতি নাজিম উদ্দিন, নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ কমিটির ক্যামেলিয়া চৌধুরী, বস্তিবাসী প্রতিনিধি মমতাজ বেগম, আব্দুর রহিম প্রমূখ। নাগরিক সংলাপের শুরুতে ধারণাপত্র উত্থাপন করেন বারসিকের কর্মসূচী কর্মকর্তা সুদিপ্তা কর্মকার।
বস্তিবাসী নেতা রাফেজা বলেন, বস্তিবাসীদের জন্য সুয়েপ পানির ব্যবস্থা সবচেয়ে জরুরি। অনিরাপদ পানি ও বর্জ্যরে মধ্যে থেকে বস্তিবাসী সবচেয়ে প্রান্তিক। আমরা আমাদের দাবিগুলো তুলে ধরতে পারিনা। আমরা যে কষ্ট করি তা শহরের অন্য মানুষরা কিন্তু করেনা। এই শহরের গরীব বস্তিবাসী ও নি¤œ আয়ের মানুষদের সুপেয় ও নিরাপদ পানির দিকে বিশেষ নগর দেবার বিকল্প নেই।
বাপা’র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মিহির বিশ^াস বলেন, আইসিডিডিআরবিতে আসন নেই এটা একটা ভয়াবহ ব্যাপার। ওয়াসার উদাসীনতা আমাদের ব্যথিত করে। ওয়াসা বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দিচ্ছেনা, যে কারণে তারা পানি ফুটিয়ে খাবেন আর আমাদের ল্যাবে কিছু পাওয়া যায়নি বলে দায় সাড়ছেন। কিন্তু অন্যান্য জায়গায় নানান জীবানুর অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে। সরকারের নীতি নির্ধারণী জায়গাগুলো থেকে নাগরিক অধিকারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো হচ্ছে। মানুষকে মর্যাদা দিচ্ছেনা।
গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, আমরা খুবই আতঙ্কিত। আমরা জানি এই পানিবাহিত রোগের সাথে যেকোন সময় ভিন্ন কোন রোগের প্রাদুর্ভাব হয়ে যেতে পাওে কারণ করোনা অভিজ্ঞতা আমাদের আতঙ্কিত হতে বাধ্য করছে। আমাদের খুব দ্রæত ডায়রিয়া মোকাবেলায় নীতিনির্ধারণী মহল সচেতন ও জরুরি পদক্ষেক গ্রহণ করবেন। পানির সংকট নিরসনে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানকে জবাবদিহিতার জায়গায় আনা জরুরি।
আওয়ামী বাস্তুহারা লীগের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ হাওলাদার বলেন, প্রত্যেক সেক্টরের অসৎ ব্যক্তিদের কারণে সরকারের দুর্নাম হচ্ছে। সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করার চেষ্টা করছে কিন্তু একটা চক্র বারবার সরকারকে বিব্রত করছে তাদের কুটকৌশলের মাধ্যমে। আমরা সরকারের সকল ক্ষেত্রে গিয়ে আমাদের এই দাবিগুলো তুলে ধরতে পারি।
বিশিষ্ট পরিবেশবিদ প্রকৌশলী মো: আব্দুস সোবহান বলেন, নিরাপদ পানির অধিকার সাংবিধানিক কিন্তু রাষ্ট সেই দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে না। যার কারণে ডায়েরিয়া সহ নানান সমস্যা হচ্ছে। আমাদের ওয়াসার এমডি হাঁসতে হাঁসতে বলেন পানি ফুটিয়ে খেতে, এটা খুবই দু:খজনক ও নিন্দনীয় বক্তব্য। ওয়াসা পানি পরিক্ষা করে কোন সসমস্যা খুজে কেন পেলনা সেটা খতিয়ে দেখা দরকার। তাদের সকল কার্যক্রমের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা জরুরি। তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশে অধিকাংশ প্রকল্প গ্রহণ হয় বাস্তবিক সমীক্ষা ছাড়াই। তাইতো বিশাল প্রকল্প নেয়া হয় কোটি কোটি টাকা খরচ হয় কিন্তু তার সুফল মানুষ পায় না।
পবা’র চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, ওয়াসার নিয়মিত পানি পরীক্ষা করে জনসমুক্ষে রিপোর্ট প্রকাশ করতে হবে। আমরা জানি তাদের পানি পরীক্ষার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু তারা যেভাবে পানির মান নিয়ে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছেন তা কোন দায়িত্বশীল আচরণ নয়। তিনি সকলকে পানির পরিমিত ব্যবহাওে আরও সচেতন হওয়ারও আহবান জানায়। তিনি আরও বলেন, সরকারের সবচেয়ে বেশি ট্যাক্স প্রদান করেন নি¤œ আয়ের মানুষ কিন্তু তারাই নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তিনি সরকারকে নি¤œ আয়ের মানুষদের সমস্যাগুলোকে আরও গুরুত্ব দিয়ে দেখার আহবান জানান।
আলোচনা সভায় বক্তারা বলেন, প্রতি বছরই দেশে ডায়ারিয়া-কলেরা রোগে প্রচুর পরিমান মানুষ মারা যায়। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্ততরের তথ্য মতে চলতি বছরের প্রথম তিন মাস (জানুয়ারী-মার্চ) সারা দেশে অন্তত পক্ষে ৪ লক্ষ, ৬১ হাজার ৬১১ জন মানুষ ডায়ারিয়া গোগে আক্রান্ত হয়েছে। আইসিডিডিআরবি-এর তথ্য মতে তাদের হাসপাতালে আসা রোগীদের ২৩ শতাংশ তীব্র ডায়ারিয়া বা কলেরা রোগে আক্রান্ত। তারা জানিয়েছেন বিগত ৬০ বছরের ইতিহাসে এত রোগীর চাপ সামলাতে হয়নি তাদের।
ঢাকা ওযাসার তথ্য মতে প্রতিদিন ঢাকার মানুষের ২৬০ থেকে ২৬৫ লিটার পানির চাহিদার বিপরিতে তারা ২৭০ কোটি থেকে ২৭৫ কোটি লিটার পানি উৎপাদন করে। যদিও এই তথ্য সঠিক নয় বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওয়ার এক কর্মকর্তা দাবী করেন। এই সামান্য পানির বিনিময়ে তাদেরকে মোটা অংকের টোল দিতে হয় অদৃশ্য শক্তিধরদের। এখানে আরেকটা মুশকিল হলো এইসব অবৈধ সংযোগের কারণে মাঝে মধ্যেই স্যুয়ারেজের বর্জ্য থেকে শুরু করে নানান রকম দূষণ ও রোগজীবানু পানির লাইনে ঢুকে পড়ে বিপুল সংক্ষক মানুষের জন্য মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরী করে। এছাড়া নগরের নি¤œ আয়ের মানুষ যারা যারা দিন রাত বেশিরভাগ সময় রাস্তাঘাটে কাটায় তারা সাধারনত খোলা বাজারের খাবার গ্রহণ করে যেখান থেকে নানা ধরণের রোগ জীবানু মানুষের শরীরে প্রবেশ করে ডায়ারিয়াসহ নানান ধরনের রোগের সৃষ্টি করে।
বিশ্ব ব্যাংকের ২০১৮ সারের এক জরিপে বলা হয়েছে শুধু গরিব মানুষ নয় বরং বাংলাদেশের প্রায় সাড়ে সাত কোটি মাসুষ অপরিছন্ন ও অনিরাপদ উৎসের পানি পান করে। পানির নিরাপদ উৎসগুলোর ৪১ শতাংশই ক্ষতিকর ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়া যুক্ত। ঢাকাসহ অন্যান্য শহরগুলোতে পাইপের মাধ্যমে বাসা বাড়িতে সরবরাহ করা পানিতে এই ব্যাকটেরিয়ার উপস্তিতি সবচেয়ে বেশী প্রায় ৮২ শতাংশ। এর সাথে ১৩ শতাংশ রয়েছে আর্সেনিক সমস্যা। ডক্টরস প্লাটফর্ম ফর পিপলহেল্থ এর তথ্যমতে দেশের ৪১ শতাংশের অধিক মানুষ দূষিত পানি পান করছে এবং চিকিৎসা করাতে গিয়ে প্রতি বছর ৬৪ লক্ষ মানুষ দরিদ্র হচ্ছে। এটা মোটেও কাম্য হতে পারে না। পাইপের মাধ্যমে সরবরাহ করা পানিতে কেন এবং কিভাবে ঢুকেছে তা দেখা দায়িত্ব পানি সরবরাহকারী কর্তৃপক্ষ এবং স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষদের। এটা মনে রাখা জরুরী শুধু পানি দিলেই হবে না ওয়াসা কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব তা সঠিকভাবে ও নিয়মিত পরীক্ষা নিরীক্ষা ও দেখভাল করা আর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আর স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের দায়িত্ব এলাকার মানুষের জন্য নিরাপদ পানীয়জলের সরবরাহ নিশ্চিত করা।
কিছু সুপারিশসমূহ্:
১. পানি বাহিত রোগ থেকে নগরের মানুষদের রক্ষা করার জন্য নিয়মিত পানির মান পরীক্ষা করে জনগনকে জানাতে হবে এবং বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করার ব্যবস্থা করতে হবে।
২. নগরের পিছিয়ে জনগোণ্ঠিকে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ক্ষেত্রে বেশী প্রাধান্য দিতে হবে।
৩. এই বছর ডায়ারিয়া কলেরা রোগের প্রার্দৃভাব কেন বেশী তা পরীক্ষ করে জনগনকে দ্রুত সচেতন করতে হবে।
৪. যে এলাকা থেকে ডায়ারিয়া রোগী বেশী আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে আসচ্ছে সেখানকার পানি পরীক্ষা করে কারণ রেব করে তা স্থানীয় মানুষকে জানাতে হবে। ওয়াসা এবং স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের দ্রুত সেখানে বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করতে হবে।
৫. ডায়ারিয়া ও কলেরা আক্রান্ত রোগীকে বিনামূল্যে চিকিওসা ব্যবস্থা করতে হবে। আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় তাদেরকে ক্ষেত্র বিশেষে আর্থিক সহযোগিতার ব্যবস্থা করতে হবে।
৬. নগরে ওয়াসার পানি সরবরাহকৃত লাইন থেকে যখন কোন আবাসিক ভরনে প্রবেশ করবে, তার মান নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ওয়াসাা এবং স্থানীয় সরকারকে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।
৭. খোলা রাস্তায় ও ছোট দোকানে খাবার বিক্রেতাদের পানি বিশুদ্ধ রাখার জন নজরদারী বাড়াতে হবে।