ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার এবং জলবায়ু পরিবর্তনে করণীয়

0
95

হৃদয় বেরাগী:- ২২ মার্চ বিশ্ব পানি দিবস। ১৯৯৩ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালিত হচ্ছে। এ দিবস উদযাপনের মূল লক্ষ্য হলো বিশ্বব্যাপি পানি সংকট সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ৬ এ বর্ণিত ২০৩০ সাল নাগাদ সকলের জন্য নিরাপদ পানি সরবরাহ ও পয়: নিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ কার্যক্রমকে বেগবান করা। এ বছরের প্রতিপাদ্য হচ্ছে “ভূগর্ভস্থ জল: অদৃশ্যকে দৃশ্যমান করা  (Groundwater: Making the Invisible Visible)Ó    । এমতাবস্থায় পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা), বাংলাদেশ নিরাপদ পানি আন্দোলন (বানিপা) ও মানবাধিকার উন্নয়ন কেন্দ্র এর যৌথ উদ্যোগে আজ ২১ মার্চ ২০২২, সোমবার, সকাল ১১ টায়, বাংলাদেশ শিশু কল্যাণ পরিষদে “ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার ও জলবায়ু পরিবর্তনে করণীয়” শীর্ষক এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)’র চেয়ারম্যান আবু নাসের খান-এর সভাপতিত্বে বানিপা’র সাধারণ সম্পাদক এম এ ওয়াহেদ এর সঞ্চালয় উক্ত আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন পবা’র সাধারণ সম্পাদক প্রকৌ. মো. আবদুস সোবহান, বাংলাদেশ নিরাপদ পানি আন্দোলন (বানিপা) এর সভাপতি প্রকৌ. মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন, মানবাধিকার উন্নয়ন কেন্ত্র’র মহাসচিব মাহবুল হক, পরিবেশ আন্দোলন মঞ্চ’র সভাপতি আমির হাসান মাসুদ, পবা’র সদস্য ইঞ্জি. তোফায়েল আহমদ, দেবীদাস ঘাট সমাজ কল্যাণ সংসদের সভাপতি মো: মুসা, মৃত্তিকা’র সমন্বয়ক খাদিজা খানম, ডাবিøউবিবি ট্রাস্ট’র প্রোজেক্ট অফিসার পদ্মা সাহা, নাসফ’র কেন্দ্রীয় কমিটি আইন বিষয়ক সম্পাদক মো: ওমর ফারুক, কবি লেখক কামরুজ্জামান ভূইয়া, বাংলাদেশ নদী বাঁচাও আন্দোলন’র কেন্দ্রীয় প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক হাসিবুল হক পুনম, জাসদ’র কেন্দ্রীয় কমিটি সহ-দফতর সম্পাদক ইঞ্জি. মো: হারুনুর রশিদ সুমন প্রমুখ।

বাংলাদেশে নদীমাতৃক দেশ। নিরাপদ পানির উৎস হচ্ছে ভূউপরিস্থ মিঠা পানি এবং ভূগর্ভস্থ পানি। এখানে রয়েছে অসংখ্য নদী, খাল, বিল, হাওর, জলাশয়। এদেশের ভূমি গঠন থেকে সভ্যতা, সংস্কৃতি, কৃষি, যোগাযোগ-সব কিছুই প্রধানত নদীর দান। বাংলাদেশ নদীনির্ভর দেশ। নদী হচ্ছে আমাদের দেশের প্রাণ। নদীর সঙ্গেই আবর্তিত এই ভূখন্ডের সভ্যতার ইতিহাস। নদীর তীরে তীরে মানুষের বসতি, কৃষির পত্তন, গ্রাম, নগর, বন্দর, সম্পদ, সম্মৃদ্ধি, শিল্প-সাহিত্য, ধর্ম-কর্ম সব কিছুর বিকাশ। বাংলাদেশের নদ-নদীর সংখ্যা অগনিত হলেও কোনটাই বিচ্ছিন্ন নয়। একে অন্যের সাথে প্রাকৃতিক নিয়মে সুশৃঙ্খলভাবে সংযোজিত। সারা দেশে নদ-নদী  জালের মতো বিস্তৃত ছিল যা এখন বিলিনের পথে।

পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র রক্ষা এবং খাবার পানি সরবরাহ, নৌ চলাচল, কৃষি ও শিল্প উৎপাদনে নদীর গুরুত্ব অপরিসীম। এদেশে রয়েছে ছোট বড় ৪০৫টি নদী। যার মধ্যে অভিন্ন নদীর সংখ্যা ৫৭টি। ৫৪টি ভারতের এবং ৩টি মিয়ানমারের সাথে সংশ্লি¬ষ্ট। দেশের নদীগুলোর ৪৮টি সীমান্ত নদী, ১৫৭টি বারোমাসি নদী, ২৪৮টি মৌসুমী নদী। মানুষের অত্যাচারে নদীগুলো আজ মৃতপ্রায়। দখল, ভরাট, আর বর্জ্যে নদীগুলো এখন নিস্তব্ধ ¯্রােতহীন এবং দূষণের ভারে পানি ব্যবহারের অযোগ্য এবং জীববৈচিত্র শূন্য হয়ে পড়ছে। ফলে পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীবন-জীবিকা আজ মারাত্বক হুমকির সম্মুখীন। দেশের নদীগুলোর প্রায় প্রতিটিরই একই দশা। তিস্তার পানি প্রবাহ ব্যাপকহারে কমে গেছে। পদ্মা, তিস্তা এখন মৃতপ্রায়, যুমনায় পড়েছে চর। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতক্ষ্যা দখল, ভরাট ও দূষণের ভারে বিষাক্ত নিঃশ্বাস ফেলছে। যে পানির অপর নাম ছিল জীবন আজ সেই বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষার পানির ওপর নাম বিষ  হিসাবে পরিলক্ষিত হয়। যেখানে এখন জলজ ও প্রাণী বসবাসের অনুপযোগী হয়ে গেছে।  

বছরে ১.২- ২.৪ বিলিয়ন টন পলি নদীবাহিত হয়ে বাংলাদেশে ঢোকে। পলি পড়ে নদীগুলোর তলদেশ ক্রমন্বয়ে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও নদীগুলো দখল, ভরাট ও দূষণের শিকার। ফলে নদীর পানি ধারণ ক্ষমতা প্রতিনিয়ত কমে যাচ্ছে, নৌ চলাচল বিঘিœত হচ্ছে এবং নদীর পানি ব্যবহারের অনুপযোগী পড়ছে। ভাটির দেশ হিসাবে অভিন্ন  নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা না পাওয়ায় আমাদের দেশে পানি সংকট আরো ঘনিভ’ত হচ্ছে এবং নৌ চলাচল, সেচ ব্যবস্থা ও জীববৈচিত্র্য হুমকীর মুখে পড়ছে। নদীতে পানি কমে যাওয়া বা না থাকায় ভূগর্ভস্থ পানির উপর নির্ভরশীলতা ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। ভূগর্ভস্থ পানি কমে যাওয়া এবং নদী হারিয়ে যাওয়ার কারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতিনিয়ত নিচে নেমে যাচ্ছে। প্রকৃতি নির্ভর ধান চাষের পরিবর্তে খরা মৌসুমে সেচ  ও রাসায়নিক সার  নির্ভর ধান চাষের ফলে ভূউপরিথ’ ও ভূগর্ভস্থ পানি সংকট তীব্রতর হচ্ছে।

বাংলাদেশ বর্ষা মৌসুমে ব্যাপক পানিতে তলিয়ে যাওয়া এবং শুষ্ক মৌসুমে পানি ঘাটতির অভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। শুষ্ক মৌসুমে কৃষি কাজে ভূউপরিস্থ পানি মাধ্যমে পরিচালিত সেচ ব্যবস্থা ব্যাহত হচ্ছে। ফলে বিপুল জনগোষ্ঠির খাদ্য চাহিদা পূরণে সেচ কাজে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করতে হচ্ছে। ১৯৮০-৮১ সালে ২০,৯০০টি অগভীর নলকূপ এবং ২০১৭-১৮ সালে ১৩,৫৫,৮৫২টি অগভীর নলকূপ, ৩৭,৫৩৮টি গভীর নলকূপ, এবং ১,৮১,৪৬৯টি অগভীর পাম্পের মাধ্যমে সেচ কার্যক্রম পরিচালিত হয়। মোট চাষকৃত জমির প্রায় ৭৩.৪৪ শতাংশ ভূগর্ভস্থ পানি এবং বাকি ২৬.৫৬ শতাংশ ভূউপরিস্থ পানির দ্বারা সেচ করা হয়। মার্চ এবং এপ্রিল মাসে প্রায় ৪ লাখ অগভীর নলকূপ অকেজো হয়ে পড়ে। অতিমাএায় ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ফলে পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে, নেমে যাচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর, বাড়ছে ঝুঁকি। কোন কোন এলাকায় সুপেয় পানির সংকট দেখা দিয়েছে। অনেক এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। ভূগর্ভে কৃএিম রিচার্জ এবং কৃষি কাজে পানি সাশ্রয়ী প্রযুক্তি ব্যবহার করার মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া প্রতিরোধ করা প্রয়োজন।

অপরিকল্পিত রাস্তাঘাট, ব্রীজ, বাঁধ নির্মাণসহ বাংলাদেশের উপর দিয়ে নদী বাহিত পলি প্রবাহের কারণে পানি সাগরে যেতে না পারায় নদীর তলদেশ ভরে যাচ্ছে। কমে যাচ্ছে নদীর নব্যতা। নদী নব্যতা হারিয়ে হাজার হাজার কিলোমিটার নৌপথ বন্ধ হয়ে গেছে আর যেটুকু বাকি আছে তাও বন্ধ হওয়ার পথে। ভাটির দেশ হিসাবে অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা না পাওয়ায় আমাদের দেশে পানি সংকট আরো ঘনিভূত হচ্ছে, জীববৈচিত্র্য হুমকীর মুখে পড়ছে, উত্তরাঞ্চলের নদীসমূহ শুস্ক বালুচরে পরিণত হচ্ছে, দক্ষিণাঞ্চলে লবনাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিদ্যমান পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা চারদিকে নদী দ্বারা বেষ্টিত। প্রাকৃতিক পরিবেশ সমৃদ্ধ এধরনের শহর পৃথিবীতে বিরল। এক গবেষণায় দেখা যায় যে, ঢাকায় জলাশয় ও নি¤œাঞ্চল-এর পরিমাণ ছিল ১৯৬০ সালে যথাক্রমে ২৯৫২ ও ১৩৫২৮ হেক্টর, ১৯৮৮ সালে  যথাক্রমে ২১০৪ ও ১২৭১৮ হেক্টর এবং ২০০৮ সালে  যথাক্রমে ১৯৯১ ও ৬৪১৫ হেক্টর।  ইতিমধ্যে প্রায় ৭০% নি¤œাঞ্চল ভরাট করা হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারিভাবে পাল্লা দিয়ে চলছে ভরাট কার্যক্রম। ভরাটের এ গতি অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সাল নাগাদ শতভাগ নি¤œাঞ্চল হারিয়ে যাবে।

দেশের অন্যান্য এলাকার মতো ঢাকাতেও  ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ভীতিকর গতিতে নিচে নেমে যাচ্ছে। ঢাকা মহানগরীতে  ১৯৭০ সালে ৪৯টি গভীর নলকূপ ছিল। ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর দূষিত পানি ব্যবহারের অনপুযোগী হওয়ায় ওয়াসা সুপেয় পানির চাহিদার শতকরা ৭৮ ভাগ ৯০০টি গভীর নলকূপের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ থেকে উত্তোলন করছে। নদীর পানি দূষিত হওয়ার অজুহাতে ওয়াসা একের পর এক গভীর নলকূপ বসিয়ে যাচ্ছে। অথচ ওয়াসাকে নদীর পানি দূষণরোধে পয়ঃবর্জ্য পরিশোধেনে কার্যকর তেমন কোন উদ্যোগ গ্রহণ করতে দেখা যাচ্ছে না। ভূগর্ভস্থ পানি অধিক উত্তোলনের ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতি বছর ১০ ফুট করে নীচে নেমে যাচ্ছে। শিল্পকারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলা হচ্ছে।  ফলে নদী দূষণের মাত্রা বেড়েই চলেছে। অন্য দিকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে লবনাক্ত পানি উজানে প্রবাহিত হচ্ছে। নদী দূষণমুক্ত ও পানি প্রবাহ বৃদ্ধি করা না হলে এবং বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে আগামি ১৫ বছরের মধ্যে পানির অভাবে ঢাকা বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে এখনই সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন।

পানি ও জলাধার সম্পর্কিত আইনসমূহ:

পানি ও জলাধার সংরক্ষনের সাথে বাংলাদেশে প্রায় ২৩টি মতো আইন রয়েছে, এগুলো হচ্ছে, বাংলাদেশ পানি আইন, ২০১৩; জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন, ২০১৩; মহানগরী, বিভাগীয় শহর ও জেলা শহরের পৌর এলাকাসহ দেশের সকল পৌর এলাকার খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন, ২০০০; পানি সম্পদ পরিকল্পনা আইন, ১৯৯২; বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড আইন, ২০০০; গ্রাউন্ড ওয়াটার ম্যানেজেমেন্ট অর্ডিন্যান্স , ১৯৮৫; বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫;  The Canal Act  ১৮৬৪;  The Embankment and Drainage Act    , ১৯৫২; পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ আইন, ১৯৯৬; রিয়েল এস্টেট উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১০;  The Ports Act, 1908; The Public Parks Act    , ১৯০৪;  The Irrigation Act    , ১৮৭৬;  The Tanks Improvement Act    , ১৯৩৯; The Cantonments Act    , ১৯২৪;  The Territorial Waters and Maritime Zones Act    , ১৯৭৪; স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) আইন, ২০০৯; স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন ২০০৯; স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন, পরিবেশ আদালত আইন ২০১০, বেসরকারী আবাসিক ভূমি উন্নয়ন বিধিমালা,  Construction & Installation control rules on Inland waterways & foreshore  ২০১০  ইত্যাদি। পানি সংক্রান্ত অনেক আইন রয়েছে এবং বিভিন্ন সংস্থা এ আইনগুলোর সাথে সম্পৃক্ত। এই আইনগুলোকে প্রধানত দুইভাবে ভাগ করা যায় এক সংরক্ষণের জন্য আইন এবং অপরগুলো পানি সম্পদ ব্যবহার সংক্রান্ত আইন।

জলাধার রক্ষায় বাংলাদেশে সর্বোচ্চ আদালত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালণ করছে।  Supreme Court on Wetland Conservation, BELA    -র এ এক প্রকাশনায় দেখা যায় উচ্চ আদালত জলাধার রক্ষা ১৪ রীট আবেদনের চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত প্রদান করেছে। এ সকল রীট আবেদন মধ্যে ঢাকার চারপাশের নদী বাঁচাতে নির্দেশনাটি অন্যতম। ঢাকার চারপাশের চার নদী বাঁচাতে ২০০৯ সালের ২৫ জুন হাইকোর্ট ১২ দফা নির্দেশনা দেন। নদীতীরবর্তী অবৈধ স্থায়ী ও অস্থায়ী স্থাপনা উচ্ছেদে এসব নির্দেশনা দেওয়া হয়। নদীর সীমানা নির্ধারণ করে সীমানায় পাকা খুঁটি বসানো, নদীর তীরে হাঁটার পথ নির্মাণ, নদীর তীরে বনায়ন করা, নদীগুলো খনন করা, নদীর তীরের জমি সিএ ও আর এস অনুসারে জরিপ করা, যমুনার সঙ্গে ঢাকার চারপাশের বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদের পানিপ্রবাহ বাড়ানোর জন্য নিয়মিত খননকাজ পরিচালনা করাসহ ১২টি নির্দেশনা দেন হাইকোর্ট। এ জন্য ভূমি, স্বরাষ্ট্র, অর্থ, নৌপরিবহন, বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সচিব, ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জের জেলা প্রশাসক, পরিবেশ অধিদপ্তর, ঢাকা সিটি করপোরেশন, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ ও ভূমি জরিপ অধিদপ্তরকে এই নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়নের নির্দেশ দেওয়া হয়। বিগত সময়ে অপর এক নির্দেশনা দেশের সকল পুকুরগুলোকে সংরক্ষনের জন্য আদালত নির্দেশণা প্রদান করেছে।

বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, জলবায়ুর পরিবর্তন, সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি, ইত্যাদির বিরুপ প্রভাব বাংলাদেশে ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক কালে বন্যা, ঘুর্ণিঝড়, সামুদ্রিক জলোচ্ছ¡াসের বর্ধিত আনাগোনা ও প্রচন্ডতায় বাংলাদেশের জনজীবন, কৃষি, ভৌত অবকাঠামো অহরহই বিপর্যস্ত হচ্ছে। জলবায়ুর প্রভাবে সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। ২১০০ সাল নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার কারণে দেশের আঠারো শতাংশের বেশী ভূমি পানির নীচে স্থায়ীভাবে তলিয়ে যাবার আশংকা রয়েছে। এছাড়াও উজানের পানি প্রবাহে লবণাক্ত পানি ঢুকে পড়বে। ফলে বিপুল জনগোষ্ঠি উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে, খাদ্য উৎপাদন ব্যাপকভাবে হ্রাস পাবে। ২০৫০ সাল নাগাদ দেশের খুলনা, বরিশাল, নোয়াখালী এলাকার ২ কোটি মানুষ জলবায়ু উদ¦াস্তু হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

সুপারিশ সমূহ:
১. ভ‚পৃষ্টের পানি ব্যবহার ব্যবহারের বিষয়টি নগর পরিকল্পনা, বসতবাড়ী পরিকল্পনা বাধ্যতামূলকভাবে যুক্ত করা। ঢাকা ওয়াসা সহ সকল নগরীতে ভূগর্ভস্থ পানির উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে নদী বা জলাশয়ের পানি ব্যবহারের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে স্বল্প মধ্যম ও দীর্ঘ মেয়াদী মাস্টার প্লান প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন প্রয়োজন।
২. প্রকৃতি ও পরিবেশবান্ধব পানি ব্যবস্থাপনায় চাষাবাদ পদ্ধতির প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা। কৃষি, শিল্পে ও ভূগর্ভস্থ পানির উপর নির্ভরতা কমিয়ে ভূউপরিস্থ পানি ব্যবহার জন্য বিভিন্ন মেয়াদী মহাপরিকল্পনা মাফিক অগ্রসর হওয়া জরুরী।
৩. বৃষ্টির পানি সোককুপ এর মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানির উন্নয়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
৪. পয়:নিষ্কাশন ব্যবস্থায় আবাসিক/অনাবাসিক এলাকায় সেফটিক ট্যাংক ও সোককুপ স্থাপনের কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
৫. জলাধার রক্ষায় পানি আইনের কঠোর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা।
৬. পানি সরবরাহ কর্তৃপক্ষকে আগামী ২ বছরের মধ্যে ভ‚পৃষ্টের পানি ৯০ % ব্যবহারের জন্য বাধ্য করা।
৭. নাগরিকদের মাঝে পানির গুরুত্ব অনুধাবনের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা।
৮. ড্রেজিং করে নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি করা এবং অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা প্রাপ্তির লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
৯. খরা মৌসুমে সেচ ও রাসায়নিক সার নির্ভর ধান চাষের পরিবর্তে প্রকৃতি নির্ভর ধান চাষের উদ্যোগ গ্রহণ করা।
১০. অপরিশোধিত শিল্পকারখানায় বর্জ্য ও পয়:বর্জ্য, নৌযানের বর্জ্য, কঠিন বর্জ্য নদীতে ফেলা বন্ধ করা।
১১. ঢাকার আশেপাশের নদীসহ অন্যান্য সকল নদী ও জলাশয় দখল, ভরাট ও দূষণ রোধকল্পে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
১২. নদী দূষণমুক্ত করা। নদীর পানি কৃষিও শিল্পে এবং পরিশোধন করে খাবার পানি হিসাবে ব্যবহার করা।
১৩. নদীর প্রবাহ ও নাব্যতা যথাযথ রাখার লক্ষ্যে নদীতে পিলারসমৃদ্ধ ব্রীজের পরিবর্তে ঝুলন্ত ব্রীজ বা টানেল নির্মাণ করা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে